জুমআর দিনের আগাম প্রস্তুতি ও বিশেষ আমল

ধর্ম ডেস্ক

জুমআর নামাজ পড়তে যাওয়ার জন্য কিছু আগাম প্রস্তুতি নেওয়া সুন্নাত। জুমআর দিন নামাজে যাওয়ার আগে এ প্রস্তুতিগুলো নেওয়ার ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন স্বয়ং বিশ্বনবি। যাতে জুমআর আজান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেরি না করে দ্রুত মসজিদে গিয়ে উপস্থিত হওয়া যায়। হাদিসে ঘোষিত ফজিলত থেকে বঞ্চিত হতে না হয়। সে জন্য জুমআর আগাম প্রস্তুতিগুলো সেরে নেওয়া। তাহলো-

১. ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা

জুমআর দিন নামাজের যাওয়ার আগে শারীরিক পরিচ্ছন্নতার দিকে নজর দেওয়া জরুরি। চুল, নখ, গোঁফ এবং অযাচিত পশম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা। হাদিসে পাকে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গোসলের আগে সাধ্যমতো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র হতে বলেছেন।

২. মেসওয়াক করে দাঁত ও মুখ পরিষ্কার করা

গোসলের আগে মুখের দুর্গণ্ধ দূর করতে দাঁত ব্রাশ করা বা মাজন ব্যবহার করা। জুমআর নামাজসহ সব নামাজ ও অজুর আগে মেসওয়াক করার কথাও বলেছেন বিশ্বনবি। এটি জুমআর আগের একটি আবশ্যক কাজ। হাদিসে এসেছে-

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘‘প্রত্যেক সাবালকের জন্য জুমআর দিন গোসল করা, মেসওয়াক করা এবং যথাসাধ্য সুগন্ধি ব্যবহার করা কর্তব্য।’ (মুসলিম)

৩. গোসল করা

জুমআর নামাজের উদ্দেশ্যে পবিত্রতা অর্জনের জন্য উত্তমরূপে গোসল করাও ইবাদতের অন্তর্ভূক্ত। জুমআর দিন গোসল করার ব্যাপারে রয়েছে জোর দিকনির্দেশনা। হাদিসের একাধিক বর্ণনায় তা প্রমাণিত-

> রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জুমআর দিনে (নামাজের আগে পবিত্রতার অর্জনের উদ্দেশ্যে) গোসল করবে; এ গোসল (তার জন্য) উত্তম।’ (তিরমিজি)

> হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমাদের মধ্যে কেউ জুমুআর নামাজে আসলে সে যেন গোসল করে।’ (বুখারি)

> হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে আরও বর্ণিত আছে, ‘ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু জুমুআর দিন দাঁড়িয়ে খুতবা দিচ্ছিলেন। এমন সময় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রথম যুগের একজন মুহাজির সাহাবি (মসজিদে) আসলেন। ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে ডেকে বললেন, এখন সময় কত? তিনি বললেন, আমি ব্যস্ত ছিলাম, তাই ঘরে ফিরে আসতে পারিনি। এমন সময় আজান শুনে শুধু অজু করে নিলাম। ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, কেবল অজুই? অথচ আপনি জানেন যে, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (জুমআর নামাজ পড়ার জন্য) গোসলের নির্দেশ দিতেন।’ (বুখারি)

> হজরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, জুমুআর দিনে প্রত্যেক সাবালক তথা প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য গোসল করা ওয়াজিব বা আবশ্যক।’ (বুখারি)

৪. তেল ও সুগন্ধি ব্যবহার করা

জুমআর নামাজের জন্য প্রস্তুতিস্বরুপ দেহের দুর্গন্ধ দূর করা, সে জন্য গোসল করা এরপর তেল ও সুগন্ধি তথা আতর ব্যবহার করা। হাদিসে এসেছে-

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জুমআর দিন গোসল করবে, যথাসাধ্য পবিত্রতা অর্জন করবে, তেল ব্যবহার করবে, অথবা নিজ পরিবারের সুগন্ধি নিয়ে ব্যবহার করবে, এরপর (জুমআর জন্য) বের হয়ে (মসজিদে) দুই নামাজির মাঝে ফাঁক সৃষ্টি করবে না (কাতার চিরবে না), এরপর ভাগ্যে যা লিখা ছিল সে পরিমাণ নামাজ পড়বে; তারপর ইমাম খুতবা দিলে চুপ থাকবে, সে ব্যক্তির ওই জুমআ থেকে আগামী জুমআ পর্যন্ত কৃত পাপ মাফ হয়ে যাবে।’ (বুখারি, মিশকাত)

৫. উত্তম পোষাক পরিধান

জুমআর নামাজের জন্য সাধ্যমত উত্তম পোশাক পরে মসজিদে আসা। যদি নতুন পোশাক না থাকে তবে যে পোশাক আছে তা জুমআর নামাজের জন্য ধুয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখা। হাদিসে এসেছে-

‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যদি জুমআর দিনে তার কর্মক্ষেত্রে ব্যবহৃত দু’টি কাপড় ব্যতিত অন্য দু’টি (উত্তম) কাপড় ব্যবহার করতে সক্ষম হয় তাহলে সে যেন তা ব্যবহার করে।’ (আবু দাউদ, মিশকাত)

৬. পায়ে হেঁটে মসজিদে যাওয়া

জুমআর নামাজের জন্য আজান শোনার সঙ্গে সঙ্গে দেরি না করে মসজিদের দিকে পায়ে হেঁটে রওয়ানা হওয়া। হাদিসে এসেছে-

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জুমআর দিন (মাথা) ধৌত করে ও যথা নিয়মে গোসল করে, সকাল-সকাল ও আগে-আগে (মসজিদে যাওয়ার জন্য) প্রস্তুত হয়, (যানবাহনে) না ওঠে পায়ে হেঁটে (মসজিদে) যায়, ইমামের কাছাকাছি বসে মনোযোগ সহকারে (খুতবা) শুনে এবং কোনো অসার ক্রিয়া-কলাপ করে না, সে ব্যক্তির প্রত্যেক পদক্ষেপের বিনিময়ে এক বৎসরের নেক আমল ও তার (সারা বছরের) রোজা ও নামাজের সওয়াব লাভ হয়!’ (মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিজি, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ)

৭. বিশেষ আমল

জুমআর দিন তথা বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে শুক্রবার সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত মুমিন মুসলমানের জন্য রয়েছে বিশেষ ৩ আমল। তাহলো-

> সুরা কাহফ তেলাওয়াত করা

হজরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জুমআর দিন সুরা কাহফ তেলাওয়াত করবে তার জন্য দুই জুমআর মধ্যবর্তীকাল জ্যোতির্ময় হবে।’ (নাসাঈ, বাইহাকি, মুস্তাদরাকে হাকেম)

আরও ফজিলত-

– অন্য বর্ণনায় আছে, ‘যে ব্যক্তি জুমআর দিন সুরা কাহফ তেলাওয়াত করবে তার জন্য তার ও কাবা শরীফের মধ্যবর্তী জ্যোতির্ময় হবে।’ (বাইহাকি)

– যে ব্যক্তি জুমার দিন সুরা কাহাফ তেলাওয়াত করবে, সে আটদিন পর্যন্ত সর্বপ্রকার ফেতনা থেকে মুক্ত থাকবে। যদি দাজ্জাল বের হয় তবে সে দাজ্জালের ফেতনা থেকেও মুক্ত থাকবে।

– এক জুমা থেকে অপর জুমা পর্যন্ত তার সব (কবিরা গোনাহ ব্যতিত) গোনাহ মাফ হয়ে যাবে।

> বেশি বেশি দরূদ পড়া

জুমআর দিনে বেশি বেশি দরূদ পড়া উত্তম ও ফজিলতপূর্ণ। যদি কোনো ব্যক্তি একবার দরূদ পড়ে তবে তার প্রতি ১০টি রহমত নাজিল হয়। আর যে ব্যক্তি জুমার দিন আসরের নামাজের পর ৮০ বার এ দরুদ পড়বে, তার ৮০ বছরের গোনাহ্ মাফ হবে এবং ৮০ বছর ইবাদতের সওয়াব তার আমলনামায় লেখা হবে। হাদিসে পাকে এসেছে-

– ‘তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ দিন হলো জুমআর দিন। এই দিনে তোমরা আমার প্রতি দরূদ পাঠ কর। যেহেতু তোমাদের দরূদ আমার কাছে পেশ করা হয়ে থাকে।’ (আবু দাউদ)

– তিনি আরও বলেন, ‘জুমআর রাত ও দিনে তোমরা আমার উপর বেশি বেশি দরূদ পড়। আর যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরূদ পড়বে; সে ব্যক্তির উপর আল্লাহ ১০ বার রহমত বর্ষণ করবেন।’ (বাইহাকি)

> জুমআর দিন বিশেষ মুহূর্তের দোয়া

জুমআর দিন আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত সময় নামাজে অতিবাহিত করা উত্তম। কিন্তু এ নামাজের অতিবাহিত করার অর্থ হলো- আসর নামাজ আদায় করে মাগরিব পড়ার নিয়তে বাকি সময় মসজিদে অবস্থান করে তাসবিহ-তাহলিলে অতিবাহিত করা। দরূদ পড়া। বেশি বেশি ইসতেগফার করা। আর তাতেই নামাজে অতিবাহিত করার সাওয়াব মিলবে। হাদিসের একাধিক বর্ণনায় এসেছে-

– হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুমআর দিনের আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, ‘এতে (এ দিনে) কিছু সময় আছে এমন, যখন কোনো মুসলিম বান্দা দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করে আল্লাহর কাছে কিছু চাইলে তিনি তাকে তা অবশ্যই দেবেন। তিনি হাতের ইশারায় দেখিয়ে দেন যে, ওই সময়টি (খুবই) অল্প।’ (বুখারি)

– হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন,নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, জুমআর দিন একটি সময় আছে যখন কোনো মুসলিম বান্দা আল্লাহর কাছে কোনো কল্যাণ চাইলে, তিনি তাকে তা অবশ্যই দেবেন। আর সেটি হলো আসরের পর।’ (বুখারি, মুসনাদে আহমাদ)

– হজরত জাবির ইবনু আব্দিল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, জুমআর দিন ১২ ঘণ্টা সময়; এর মধ্যে একটি সময় আছে এমন, যখন কোনো মুসলিম বান্দা আল্লাহর কাছে কিছু চাইলে, তিনি তাকে তা অবশ্যই দেবেন। সুতরাং তোমরা আসরের পর শেষ সময়টুকুতে তা অনুসন্ধান কর।’ (আবু দাউদ)

– হজরত আবু মুসা আশআরি রাদিয়াল্লাহু আনহুর ছেলে হজরত আবু বুরদা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু আমাকে বলেন, তুমি কি তোমার পিতাকে জুমআর দিনের (বিশেষ) সময়ের মর্যাদা সম্পর্কে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোনো হাদিস বর্ণনা করতে শুনেছ?

আমি বলি, ‘হ্যাঁ’, আমি তাকে বলতে শুনেছি, আমি (আবু ‍মুসা আশআরি) আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি- সেটি হলো ইমামের (বৈঠকে) বসা থেকে নামাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত মাঝখানের সময়টুকু।’ (মুসলিম)

আল্লামা ইবনুল কায়্যিম ও অন্যান্য ইসলামিক স্কলারগণ যে মতটি দিয়েছেন, তাহলো- জুমআর দিন দোয়া কবুলের সেই সময়টি হলো আসরের পর। (যাদুল মাআদ)

আল্লামা ইবনুল কায়্যিম বলেন, আমার মতে নামাজের সময়টি মূলত এমন এক সময়, যখন দোয়া কবুলের আশা করা যায়। (সাধারণত নামাজের সময় ও আসরের পর-) উভয়টি হলো দোয়া কবুলের সময়; যদিও বিশেষ এ সময়টি হলো আসরের পর। এটি নির্দিষ্ট। আগে পরে হওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। তবে ‘নামাজের সময়’ কথাটি নামাজের আগের ও পরের উভয় সময়কেই বোঝায়।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে জুমআর দিন আগাম প্রস্তুতি গ্রহণ করে আগে আগে মসজিদে যাওয়ার তাওফিক দান করুন। বিশেষ আমলে জুমআর দিন অতিবাহিত করার তাওফিক দান করুন।

আমিন।

Facebook Comments