রাজধানীর কলাবাগান মাঠে পূজামণ্ডপ করতে না দেওয়ার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। সংস্থাটি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলছে, সম্প্রতি ‘ধানমন্ডি সার্বজনীন পূজা কমিটি’ এক সংবাদ সম্মেলনে কলাবাগান মাঠে পূজামণ্ডপ করতে না দেওয়ার বিষয়ে ডিএসসিসির বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করেছে। এর মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদান এবং অনাকাঙ্ক্ষিত তথ্য উপস্থাপন করেছে ওই কমিটি। বিষয়টি ডিএসসিসির দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এতে ডিএসসিসির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপপ্রয়াস সুস্পষ্ট।
ডিএসসিসির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পূজা কমিটির সংবাদ সম্মেলনে সরবরাহকৃত লিখিত বক্তব্যে ‘ধর্ম নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে পাওয়া স্বাধীনতা আজ সাম্প্রদায়িকতার আঘাতে নীরবে কাঁদে!’ শীর্ষক বক্তব্য অত্যন্ত পীড়াদায়ক এবং এতে গর্হিত শব্দমালা ব্যবহার করা হয়েছে। এ ধরনের বিদ্বেষমূলক বক্তব্যে আমরা খুবই মর্মাহত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশ আজ যখন প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সারাবিশ্বে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল ও অনন্য উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত, তখন এ ধরনের বক্তব্য স্বার্থন্বেষী মহলের ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য সাধন ও চাঁদাবাজির অভিলাষ পূরণের নামান্তর।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, সংবাদ সম্মেলনে ‘স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অনুমতিপত্র থাকার পরও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অসহযোগিতার কারণে’ পূজা উদযাপন করতে পারছেন না বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অভিযোগ করেছেন। কিন্তু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে ‘পূজা উদযাপন কমিটি কর্তৃক পূজা উদযাপনকালে কলাবাগান ক্রীড়াচক্র মাঠ ও মাঠের স্থাপনাসমূহের কোনো প্রকার ক্ষয়ক্ষতি/বিনষ্ট না হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে’ এমন শর্তসাপেক্ষে পূজা আয়োজনের অনুমতি প্রদান করার বিষয়টি সংবাদ সম্মেলনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা উল্লেখ করেননি। ফলে আংশিক তথ্য সরবরাহের মাধ্যমে ডিএসসিসির পাশাপাশি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সার্বিক অবস্থানকেও প্রশ্নবিদ্ধ করার অপপ্রয়াস লক্ষণীয়।
‘এছাড়া মন্ত্রণালয় প্রদত্ত ‘শর্তসাপেক্ষ অনুমতি প্রদান’ করার জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাছে যে পত্র পাঠানো হয়েছে, সে পত্রে প্রদত্ত শর্তপূরণে—পূজা আয়োজনের ফলে কলাবাগান মাঠ কিংবা প্রকল্প এলাকায় কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হলে তার যথার্থ ক্ষতিপূরণ বা জরিমানা দেওয়া হবে, এমন নিশ্চয়তা প্রদানপূর্বক কমিটির পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত ডিএসসিসির কাছে কোনো আবেদনও করা হয়নি।’
বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, কলাবাগান মাঠ ও সংশ্লিষ্ট এলাকায় ২০১৮ সাল থেকে একটি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় কলাবাগান মাঠের উন্নয়ন, মাঠ থেকে ধানমন্ডি-৩২ এবং মাঠ থেকে ধানমন্ডি হ্রদের পানসি রেস্তোরাঁ পর্যন্ত পথচারীদের হাঁটার পথ (ফুটপাত), মাঠের চারপাশে নর্দমা (ড্রেনেজ) ব্যবস্থা ও হ্রদের পাড়ে হাঁটার পথ (ওয়াক ওয়ে) নির্মাণ, মাঠে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলার জন্য সুবিধা সংবলিত অনুষঙ্গ সৃষ্টি এবং অনুশীলনের জন্য জাল (নেট) স্থাপন ইত্যাদি বহুবিধ কর্মযজ্ঞ চলমান।
‘২০১৮ সালে প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার পর ২০১৯ সালে কলাবাগান মাঠে বিশেষ বিবেচনায় এর ক্ষয়ক্ষতি না করা এবং ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হলে তার যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান করার শর্তে দুর্গাপূজা আয়োজনের অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু মাঠের যে অংশে দুর্গাপূজা আয়োজন করা হয়, সেই অংশের ঘাস সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যায়। পূজা আয়োজনে খোঁড়াখুঁড়ির ফলে মাঠ ভরাটে ব্যবহৃত বালি সরিয়ে ফেলায় মাটির নিচের থাকা খোয়া বেরিয়ে আসে। এছাড়া মাটির নিচে স্থাপিত পারফোলড পাইপ পারফোরেটেড পাইপ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পুরো মাঠ ময়লা-আবর্জনায় ভরে ওঠে। সামগ্রিকভাবে সে সময় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২৫ লাখ টাকা। ক্ষয়ক্ষতি হলে তার ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে মর্মে মুচলেকা হলেও বস্তুত কমিটি কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে দেয়নি।’
‘অধিকন্তু ২০১৯ সালের পূজা আয়োজন এবং আয়োজনজনিত কলাবাগান মাঠের ক্ষয়ক্ষতি সাধনের পরেও কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ প্রদান না করার পীড়াদায়ক ও রগরগে অভিজ্ঞতা বলে দেয়, কমিটি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের প্রশ্নবিদ্ধ দায়িত্বশীলতার ফলে তাদের লিখিত কিংবা মৌখিক মুচলেকা কিংবা অঙ্গীকারনামায় ভরসা রাখা যায়, এমন কোনো উপকরণ অবশিষ্ট আছে!’
ডিএসসিসি জানায়, করোনা মহামারির কালো থাবায় বিপর্যস্ত পুরো বিশ্ব। বাংলাদেশও এই মহামারির কবল মুক্ত হয়নি। ফলে করোনা মহামারিকালে পূজা আয়োজনে গত ৫ অক্টোবর ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে পূজা আয়োজনে যে নির্দেশনা (জরুরি বিজ্ঞপ্তি) দেওয়া হয়েছে, তাতে মন্দিরগুলোতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত বিষয়াবলি উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে উন্মুক্ত স্থানে পূজা আয়োজনের বিষয়ে অনুমতি প্রদানে সরকারের তরফ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের শৈথিল্য দেওয়া হয়নি।
‘এছাড়া ইতঃপূর্বে পূজা আয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গের তরফ থেকে কলাবাগান মাঠের পরিবর্তে অন্য কোনো স্থানে কিংবা মাঠে পূজা আয়োজনের চেষ্টা করার লক্ষ্যে ডিএসসিসির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের সহযোগিতা চাওয়া হয়। তখন মেয়র ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অনুমতি সাপেক্ষে অন্য কোনো স্থান কিংবা মাঠে পূজা আয়োজন করা হলে করপোরেশন তাতে সহযোগিতা করবে বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন এবং হস্তান্তর হওয়ার আগ পর্যন্ত কলাবাগান মাঠে পূজা আয়োজন করার সুযোগ নেই বলে সুস্পষ্টভাবে জানানো হয়।’
সংবাদ সম্মেলনে ধানমন্ডি, নিউমার্কেট, কলাবাগান, হাজারীবাগ, মোহাম্মদপুর এলাকায় কোনো মন্দির নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ধরনের বক্তব্য পুরোপুরি মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর উল্লেখ করে ডিএসসিসি বলছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়র ঢাকা-১০ আসনের সংসদ সদস্য থাকাকালে ধানমন্ডি ও হাজারীবাগ এলাকায় ৮টি মন্দিরের উন্নয়ন ও সংস্কার সম্পন্ন করেছেন। সুতরাং সংবাদ সম্মেলনে এ ধরনের তথ্য প্রদান করার মাধ্যমে অশুভ কোনো উদ্দেশ্য সাধনের ইঙ্গিত করে। সংশ্লিষ্ট এলাকায় কতগুলো মন্দির আছে, যারা তা জানেন না বরং তাদের কাছে একমাত্র স্থান হিসেবে কলাবাগান মাঠকে বিবেচনা করার অর্থ—ধর্মের নামে নিজেদের পকেট ভারী করতে ব্যবসায়িক পুঁজি আহরণ এবং চাঁদাবাজির মহোৎসব সম্পাদন বৈ আর কিছু হতে পারে না। দুর্গাপূজার মতো একটি ধর্মীয় উৎসবকে উপলক্ষ করে যারা মিথ্যাচার করতে পারেন—তাদের উদ্দেশ্য যে ধর্মীয় আরাধনা নয়, সেটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট।
ডিএসসিসির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, প্রকল্প চলাকালে কলাবাগান মাঠে দেশের সংখ্যাগুরু মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রধান ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর ও পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে ঈদ জামায়াত আয়োজনে কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি। বাস্তবতা বিবেচনায় এবং মাঠের ক্ষতিসাধন থেকে বিরত থাকার মহত্তম অভিপ্রায়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ওই মাঠে সব ধর্মীয় আয়োজন থেকে বিরত থেকেছেন, যা অত্যন্ত সাধুবাদ যোগ্য।
‘বস্তুত সব ধর্মের প্রতি সমব্যবহার নিশ্চিত করা এবং কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন না করার মাধ্যমে যখন সাংবিধান প্রদত্ত নাগরিক অধিকারের সুরক্ষা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হচ্ছে, তখন এ ধরনের উসকানির পেছনে নানাবিধ রহস্য খেলা করছে বলে প্রতীয়মান।’
‘যারা মন্দিরের সংখ্যা ও অবস্থান জানেন না, তাদের আর যাই হোক, অন্তত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান সম্পাদন করাই একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। ধর্মের নামে এ ধরনের একতরফা মিথ্যাচার, ধর্মীয় বাতাবরণে ধর্মীয় উসকানি এবং ধর্ম-ব্যবসার সুবিধা লাভের অশুভ পাঁয়তারার বিরুদ্ধে সমাজের সব শ্রেণি-পেশা ও ধর্মমতের মানুষের সুদৃঢ় অবস্থানকে ত্বরান্বিত করবে বলেই আমরা বিশ্বাস করি।’
ডিএসসিসির বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, চলমান এ উন্নয়ন প্রকল্প চলতি বছরের ডিসেম্বরে সম্পন্ন করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে এবং সে মোতাবেক উন্নয়ন কার্যক্রম পুরোদমে চলমান। প্রকল্পের আওতায় কলাবাগান মাঠ সংলগ্ন শিশুদের ‘কিডস জোন’র উন্নয়ন করা হচ্ছে। সেখানে ২৯টি রাইড স্থাপন করা হবে। প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষে কলাবাগান মাঠের পাশাপাশি কিডস জোনটিকে ‘শহীদ শেখ রাসেল শিশু পার্ক’ নামে উদ্বোধন করার পরিকল্পনা রয়েছে।