হাজার স্বপ্নের সারথি শেখ হাসিনা

মোঃ রাসেল

আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৪৭ সালে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বেড়ে ওঠেন রাজনৈতিক সংস্পর্শে। রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম হওয়ায় রাজনীতির বাইরে যেতে পারেননি শেখ হাসিনা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের পরে ছয় বছর প্রবাস জীবন কাটে বঙ্গবন্ধুকন্যার।

বাবার হাতে গড়া আওয়ামী লীগের রাজনীতি দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়ে। দলকে ঐক্যবদ্ধ করার দায়িত্ব শেখ হাসিনার কাঁধে এসে পড়ে ১৯৮১ সালে। সভাপতি নির্বাচিত হয়ে দেশে ফেরেন ওই বছরের ১৭ মে। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে কাজ শুরু করেন। অমসৃণ ও কণ্টকাকীর্ণ ওই পথ পাড়ি দিতে ৭৫ বছর বয়সী শেখ হাসিনাকে ১৯ বার মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়তে হয়। ১৯ দফায় সন্ত্রাসী হামলা থেকে প্রাণে বেঁচে যান তিনি।

১৯৮৮ সাল থেকে হামলার মুখোমুখি হন। সর্বশেষ শেখ হাসিনার প্রাণনাশের জন্য সন্ত্রাসী হামলা হয় ২০১৫ সালে। মৃত্যুকে ভয় পেয়ে থেমে থাকেননি শেখ হাসিনা। বরং সাহসিকতার সঙ্গে বলেন, আমি মৃত্যু ভয় করি না। জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও এদেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাব। রাজনীতি করতে এসে এতবার হামলার শিকার হওয়া রাজনৈতিক নেতা খুব কমই আছেন।

বাবা ছিলেন দেশের মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, এমনকি রাষ্ট্রপতিও। তবু সাড়ম্বরে সন্তানদের জন্মদিন পালন করা হতো না ঐতিহাসিক ওই বাড়িতে। সন্তানদের জন্মদিনে কেক কাটা হতো সাদামাটাভাবেই, মিলতো না কোনও উপহার। তবে বাড়তি আয়োজনের মধ্যে থাকতো একটু ‘ভালো রান্না’। সবাই মিলে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব দম্পতির সন্তানদের জন্মদিনগুলো এভাবেই পালিত হতো।

বড় কেক কাটা, আত্মীয়-স্বজন নিমন্ত্রণ করে ভূরিভোজ করা—এমন সাড়ম্বর আয়োজন কখনও হয়নি বঙ্গবন্ধুকন্যা, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিনকে ঘিরে। বাবার পরিবারে তার জন্মদিন যেমন সাদামাটা ছিল, তেমনই বিয়ের পরে স্বামীর ঘরেও সাদামাটাভাবেই কেটেছে তার জন্মদিন।

প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনের আয়োজন সম্পর্কে জানাতে গিয়ে তারই খালাতো ভাই শেখ শহীদুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে এসব কথা বলেন। শেখ হাসিনার জন্মদিনে কেমন থাকতো ওই বাড়ির পরিবেশ, কিংবা বিয়ের পর স্বামীর বাসায় কেমন কাটতো তার জন্মদিন, সে বিষয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন শেখ শহীদুল ইসলাম।

শেখ হাসিনার জন্মদিনের একটি ঘটনা উল্লেখ করে বয়সে এক বছরের ছোট খালাতো ভাই শেখ শহীদ বলেন, ‘১৯৬৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর হাসিনা আপার জন্মদিনের একটি ঘটনা স্পষ্ট স্মৃতিতে রয়েছে। ওই জন্মদিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সকালে ঘুম থেকে উঠে ৫০০ টাকা তাঁর বড় মেয়ে শেখ হাসিনার হাতে দিয়ে বলেছিলেন—‘এটা দিলাম জন্মদিন উপলক্ষে উপহার। তোর মতো করে খরচ করে নিস। অন্য জন্মদিনগুলোতে একটু-আধটু উপহার দিতেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু কেক কাটা, বিরাট অনুষ্ঠান করা—জন্মদিনে এ ধরনের কোনও কিছু বঙ্গবন্ধুর বাসায় হতো না।’

ছাত্রজীবনে প্রায় ১০ বছর ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সঙ্গে কাটানো শেখ শহীদ বলেন, ‘আমাদের বাসায় ওইভাবে সাড়ম্বরে জন্মদিন পালন হতো না। বঙ্গবন্ধু নিজের জন্মদিনও সাড়ম্বরে পালন করতেন না। পরিবারের সদস্যদেরও জন্মদিন সাড়ম্বরে পালন করা হতো, তবে ওইদিন একটু ভালো খাবার-দাবারের আয়োজন থাকতো। সেটা বেগম মুজিব নিজেই তত্ত্বাবধান করতেন। ওই দিন সবাই মিলে একসঙ্গে খেতাম। তবে পরিবারের বাইরের কেউ থাকতো না। এভাবেই সাধারণভাবে জন্মদিন কেটে যেত।’

তিনি জানান, হাসিনা আপার জন্মদিনে ভাইবোনেরা মিলে উইশ করতাম। সবাই মিলে আনন্দ করতাম। বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন, মেহমান ডেকে ভূরিভোজের কোনও আয়োজন হতো না। তবে জন্মদিন মনে করে বাসায় কেউ এলে তারা খাওয়া-দাওয়ায় আমাদের সঙ্গে যোগ দিতেন, এটুকুই ছিল জন্মদিন।

শেখ শহীদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু প্রকাশ্যেই বলতেন—দেশের মানুষের জীবনের কোনও মূল্য নেই, যে দেশের মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, একবেলা একমুঠো খেতে পায় না, সেই দেশে ঘটা করে জন্মদিন পালনের কি কোনও সার্থকতা আছে? এটা উনি নিজের ক্ষেত্রে বলেন।’

শেখ হাসিনার খালাতো ভাই শেখ শহীদ আরও বলেন, ‘১৯৬৮ সালে হাসিনা আপার বিয়ে হয়। বিয়ের সময় আমরা কেউ উপস্থিত থাকতে পারিনি। বঙ্গবন্ধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ক্যান্টনমেন্টে বন্দি ছিলেন।

শেখ হাসিনার বিয়ের পরের বছরের জন্মদিনের স্মৃতিচারণ করে শহীদ বলেন, ‘ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে একটা জন্মদিনে ১৯৬৯ সালে হাসিনা আপা ৩২ নম্বরের অদূরে স্বামীর ৬৮০ নম্বরের দোতলা বাসায় ছিলেন। আমরা জন্মদিনে ওই বাসায় যাই। ওই বাসায় ওয়াজেদ সাহেব খাবারের আয়োজন করেন। পরিবারের ভাইবোনেরা সবাই মিলে হাসিনা আপাকে উইশ করি। সবাই মিলে হৈ- হুল্লোড় করে চলে আসি।’

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশকে আধুনিক, বিজ্ঞানভিত্তিক ও উন্নত-সমৃদ্ধ দেশের দিকে এগিয়ে নিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ক্ষেত্রে তার নেওয়া পদক্ষেপের বস্তবায়ন এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে রেখে চলা অবদান সারা বিশ্বেই প্রশংসিত। সফলতার স্বীকৃতি হিসেবে ‘ভ্যাকসিন হিরো’, ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ’, ‘স্টেট ম্যান’, ‘স্টার অব ইস্ট’, ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ ইত্যাদি সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তিনি।

বঙ্গবন্ধুকন্যার মাধ্যমে আজ বাংলাদেশ ‘সমুদ্র জয়’ থেকে শুরু করে অর্জন করেছে ‘চ্যাম্পিয়ন্স অব দ্য আর্থ’-এর মতো সম্মাননা।

১৯৯৬ সালে প্রথম ক্ষমতায় এসে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যোগ্যতার বহির্প্রকাশ ঘটান শেখ হাসিনা। দীর্ঘ দুই দশকের অস্থিরতার অবসান ঘটিয়ে দেশের পার্বত্য এলাকায় শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য ইউনেস্কো তাকে ‘হুপে-বোয়ানি’ শান্তি পুরস্কার দেয়। ক্ষমতার ওই মেয়াদেই জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ‘ক্ষুধার বিরুদ্ধে আন্দোলন’-এ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ শেখ হাসিনাকে সম্মানজনক ‘সেরেস’ (CERES) মেডেল প্রদান করে। সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে মানবিকতার অনন্য উদাহরণ হয়ে উঠেছেন তিনি।

বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ঘনিষ্ঠ ও পারস্পরিক সন্তোষজনক সম্পর্ক, নিজ দেশের জনগণের কল্যাণ, নারী ও শিশু এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতায় অবদানের জন্য ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ড. এ পি জে আবদুল কালামের নামে প্রতিষ্ঠিত ড. কালাম স্মৃতি ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কাউন্সিল-এর ‘ড. কালাম স্মৃতি ইন্টারন্যাশনাল এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড-২০১৯’ পান।

মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত হয়ে আসা ১০ লাখের মতো রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক প্রশংসিত হন শেখ হাসিনা। অসহায় মানুষগুলোর প্রতি মানবতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় তিনি ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ উপাধিতে ভূষিত হন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দানে দায়িত্বশীল নীতি ও তার মানবিকতার জন্য প্রধানমন্ত্রী ‘আইপিএস ইন্টারন্যাশনাল অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ এবং ২০১৮ সালে ‘স্পেশাল ডিসটিংশন অ্যাওয়ার্ড ফর লিডারশিপ পদক’ পান। বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নিউজ এজেন্সি ‘দি ইন্টার প্রেস সার্ভিস-আইপিএস’ এবং নিউইয়র্ক, জুরিখ ও হংকং-ভিত্তিক তিনটি অলাভজনক ফাউন্ডেশনের নেটওয়ার্ক গ্লোবাল হোপ কোয়ালিশন ২০১৮ সালে শেখ হাসিনাকে এ দুটি পদক প্রদান করে।

২০১৫ সালে শেখ হাসিনা বিশ্বের সর্বোচ্চ পরিবেশ-বিষয়ক পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ’ পুরস্কার লাভ করেন। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় দূরদর্শী পদক্ষেপ নেওয়ায় তাকে এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ওই বছরেই জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে আইসিটির ব্যবহারে প্রচারণার জন্য শেখ হাসিনাকে ‘আইসিটি সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করা হয়। ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যগুলো (এমডিজি) অর্জনে বিশেষ করে শিশুমৃত্যুর হার হ্রাসে অবদানের জন্য জাতিসংঘের অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।

নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় অগ্রগামী

উইমেন ইন পার্লামেন্ট (ডব্লিউআইপি) ও ইউনেস্কো বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীকে ‘ডব্লিউআইপি গ্লোবাল ফোরাম অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করেছে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রাজনৈতিক অঙ্গনে লিঙ্গ বৈষম্য হ্রাসে অগ্রণী ভূমিকা পালনের জন্য ২০১৯ সালে তাকে এ পদক দেওয়া হয়। নারী শিক্ষা প্রসারের জন্য ২০১৪ সালে শেখ হাসিনাকে ‘ট্রি অব পিস’ পুরস্কার দেওয়া হয়।

এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্লোবাল উইমেনস লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। ২০১৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘গ্লোবাল সামিট অব ওমেন’ তাকে এই সম্মাননা দেয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দু’বার সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য খাতে তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস এবং ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ২০১১ ও ২০১৩ সালে তাকে এই সম্মাননা দেওয়া হয়। নারীর ক্ষমতায়নে অসামান্য অবদান রাখার জন্য ২০১৬ সালে ইউএন উইমেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ’ পুরস্কার ও ‘প্লানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ পদক প্রদান করে।

টিকাদান কর্মসূচিতে বাংলাদেশের সফলতার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ২০১৯ সালে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পুরস্কার দিয়েছে গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনেশন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন (জিএভিআই)।

এছাড়া ১৯৯৯ পার্ল এস বাক অ্যাওয়ার্ড, মাদার তেরেসা পদক, এমকে গান্ধী পদক, ২০০৯ সালে ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পুরস্কার, ইন্দিরা গান্ধী স্বর্ণ পদক, হেড অব স্টেট পদক, ২০১১ ও ২০১২ গ্লোবাল ডাইভার্সিটি অ্যাওয়ার্ড, ১৯৯৭ নেতাজী স্মৃতি পুরস্কার পান।

খাদ্য উৎপাদনের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ও আইসিটি উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটি তাকে সনদ প্রদান করে।

Facebook Comments