গর্ভকালে ডেঙ্গু জ্বর

ডা. সামিনা চৌধুরী
অধ্যাপক, স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিশেষজ্ঞ

অন্যসময়ে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হওয়া এবং গর্ভকালীন অবস্থায় আক্রান্ত হওয়ার মধ্যে বিরাট একটা পার্থক্য রয়েছে। কারণ সে শরীরের অভ্যন্তরে বহন করে চলেছে ছোট্ট এক মানবশিশু। কাজেই ঝুঁকিটা থাকে দুজনেরই।

ডেঙ্গুজ্বর একটি ভাইরাসজনিত রোগ যা স্ত্রী জাতীয়এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। ডেঙ্গু ভাইরাস এই মশার মাধ্যমে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর থেকে রক্ত নিয়ে আরেকজন ব্যক্তিকে কামড়ে দিলে এই ভাইরাসটি তার শরীরে চলে যায়। মশা কামড়ের কদিন পর থেকে রোগের লক্ষণগুলি প্রকাশ পায়। তবে কোনো কোনো সময়ে লক্ষণ প্রকাশ নাও পেতে পারে।

ডেঙ্গু ভাইরাসের মধ্যেও আবার রকমফের আছে। চার ধরনের ভাইরাস আছে এর মধ্যে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোম মারাত্মক।বাকিগুলো মারাত্মক নয়।তবে সচেতন থাকতে হবে সবাইকে।

এখন জেনে নেয়া যাক শরীরে এই ভাইরাসটি প্রবেশ করে কী কাজ করতে থাকে। প্রথমে শরীরে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গের উপর প্রদাহ তৈরি করে। কাজেই শরীরে জ্বর এসে যায় এবং শরীরে ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে। যখন এই ভাইরাসটি রক্তনালী, কিডনি, লিভার এবং রোগ প্রতিরোধের সিস্টেমকে আঘাত করে তখন মারাত্মক আকার ধারণ করে। রক্তনালীতে যখন আঘাত হানে তখন রক্তনালীর ভিতরে থাকা রক্তের পানি জাতীয় তরলটি রক্তনালীর বাইরে চলে আসে। রোগীর শরীরে তখন রক্তচাপ কমতে থাকে এবং এক পর্যায়ে গিয়ে শরীরের সবচেয়ে প্রধান অঙ্গগুলিই (যেমন- ফুসফুস, মস্তিষ্ক, লিভার, কিডনি) শুধু নয়, সারা শরীরেই রক্ত চলাচল কমে যায়। তখন বিপর্যয় শুরু হয়ে যায়। লিভারের প্রদাহের কারণে লিভার থেকে যে সকল উপাদান রক্ত জমাট বাঁধার কাজে সাহায্য করে সেই সকল প্রোটিনের ঘাটতি পড়ে যায় এবং সেই সাথে ঘাটতি পড়ে যায় প্লাটিলেটের। এই সব কিছুর কারণে রোগী অসুস্থ হয়ে যায়। রোগীর নাড়ির গতি দ্রুত ও দুর্বল হয় এবং রক্তচাপ কমে যায়। রোগীর রক্তক্ষরণ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। রক্তেরনালী থেকে বের হওয়া প্লাজমাবাজলীয় অংশ শরীরের বিভিন্ন যায়গায় বিশেষ করে পেটে, ফুসফুসে পানি জমে যায়। রক্তের চাপযদি আরো কমতে থাকে তখন শরীরের প্রায় সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ কার্যকারিতা হারাতে থাকে। রোগী মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে যায়। প্রস্রাবও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

গর্ভবস্থায় এই সব অবস্থা হতে পারে। এমনকি গর্ভের শিশুটিও মায়ের সাথে নাভীরজ্জু ও গর্ভফুলের যোগ রয়েছে যেখানে রক্তচাপ বেশি কমে যেতে পারে। কাজেই শিশুটিও ঝুঁকির মুখে পড়ে যায়।অনেক সময় গর্ভেই শিশুটি মরে যেতে পারে।

এখন দেখে নেয়া যাক লক্ষণগুলো কি কি?

* হঠাৎ করেই জ্বর এসে যায়, মাত্রা ১০৫ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠতে পারে। এই জ্বর প্রায় ২-৭ দিন থাকে। জ্বরের সাথে সাথে গায়ে ও হাড়ে মারাত্মক ব্যথা হয়। ডেঙ্গুর আরেক নাম “হাড় ভাঙা জ্বর” যা এই মাংসপেশি ও হাড়ের সংযোগস্থল থেকে এসেছে। মেরুদণ্ড ও কোমরে ব্যথা, চোখব্যথা, মাথাব্যথা হয়ে থাকে। অনেকের পেটে ব্যথা হয়। যদি হেমোরেজিক ডেঙ্গু হয় তাহলে শরীরে বিভিন্ন অঙ্গ থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হতে পারে।

গর্ভকালীন অবস্থায়ও এই উপসর্গগুলো হতে পারে। গর্ভকালীন অবস্থায় প্রথমদিকে আক্রান্ত হলে গর্ভপাত,পরবর্তীতে অপরিণত বয়সের শিশুর জন্ম, মৃত শিশু এবং পূর্ণ সময়ের আগেই প্রসব ব্যথা উঠতে পারে। গর্ভফুলের পিছনে রক্তক্ষরণ হতে পারে। তখন পরিস্থিতি খুব জটিল হয়ে যায়।

প্রায় শতকরা ৫% ক্ষেত্রে যখন প্রবল আকার ধারণ করে তখন পেটে ও ফুসফুসে, মস্তিস্কে, বিভিন্ন অঙ্গে পানি জমে যায়, রক্তচাপ কমে যায় এবং হৃদস্পন্দন খুব দুর্বল ও দ্রুত হয় যাকে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম বলা হয়। রোগীর অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায় মৃত্যুর আশঙ্কা বেড়ে যায়। কাজেই সেই সময়ে হাসপাতালে নিবিড় পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে হয়।

সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয় যদি গর্ভবতী মহিলা গর্ভাবস্থার শেষের দিকে আক্রান্ত হয়।তখন অনেক সময় প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। এছাড়াও এই ভাইরাসটি মা থেকে শিশুর মধ্যে চলে আসতে পারে এবং আক্রান্ত নবজাতকের মধ্যে লক্ষণগুলো প্রকাশ হতে থাকে। শিশুটিকে নিবিড় পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখতে হয়।

কি করণীয়-

প্রথমত: জ্বরের মাত্রা নামিয়ে রাখতে হবে। সেজন্য প্যারাসিটামল বড়ি সেবন করতে হবে। কুসুম গরম পানিতে গা মুছতে হবে বা গোসল করতে হবে।

দ্বিতীয়ত: প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার বারে বারে খেতে হবে। স্যালাইনের পানি, ডাবের পানি, স্যুপ, ডালের পানি, ফলের রস, লেবুর সরবত পান করতে হবে এবং সহজপাচ্য নরম খাবার খাবে।

তৃতীয়ত: রোগীকে বেশির ভাগ সময় বিশ্রামে থাকতে হবে।ডেঙ্গুজ্বর হলে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক ও নন স্টেরয়েডাল প্রদাহ পশমী সেবন করা যাবে না।

সতর্কীকরণ চিহ্ন হিসাবে বেশি পেটে ব্যথা, ঘন ঘন বমি, লিভার বড় হয়ে যাওয়া, পেশিতে রক্তক্ষরণ হওয়া অনুচক্রিকা কমে যাওয়া (চিকিৎসকের পরামর্শে থাকা দরকার), অসম্ভবরকম দুর্বলতা, ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস, অস্থিরতা উল্লেখযোগ্য। এই ধরনের যে কোনো চিহ্ন দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।

ল্যাবরেটরী পরীক্ষা:

কমপ্লিট ভাইকাউন্ট- হিমাটোক্রিক ও প্লাটিলেটকাউন্ট, এন এস ওয়ান এন্টিজেন পরীক্ষা জ্বর হবার প্রথম ২/৩ দিনের মধ্যে করতে হবে। ডেঙ্গু অ্যান্টিবডি- ৫/৭ দিন পার হলে করতে হবে। এ ছাড়াও, চিকিৎসকের পরামর্শে প্রয়োজনে লিভার ফাংশন টেস্ট, সিরাম অ্যালবুমিন; ইলেকট্রোলাইট, কোয়াগুলেশন প্রোফাইল, বুকের এক্সরে, পেটের আল্ট্রাসাউন্ড ও অন্যান্য পরীক্ষা করতে হবে।

মূলবার্তা:

১. গর্ভকালে ডেঙ্গুজ্বর হলে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করা উচিত।

২. ডেঙ্গু প্রকোপ এলাকায় একজন স্বাস্থ্যকর্মীকে গর্ভকালীন সময়ে যেকোনো ধরনের জ্বর হলে ডেঙ্গু জ্বরের কথা চিন্তা করতে হবে।

৩. প্রবলভাবে আক্রান্ত সময়ে প্রসবের ব্যথা ত্বরান্বিত করা বা সিজারিয়ান ডেলিভারি না করাই ভালো।

৪. সন্তান প্রসব অবশ্যই হাসপাতালে করাতে হবে,যেখানে রক্তক্ষরণ/ অনুচক্রিকা সঞ্চালন এবং দক্ষ চিকিৎসক আছে।

৫. অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সমন্বিত টিম গঠন করে চিকিৎসা করা উচিত।

৬. সন্তান প্রসবের সময় রক্তের অনুচক্রিকা দেয়া প্রয়োজন এবং রক্তসঞ্চালন, ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা তৈরি রাখতে হবে। কারণ যেকোনো সময় এর প্রয়োজন হতে পারে।

৭. রক্তক্ষরণ বন্ধ হবার জন্য অক্সিটোসিন জরায়ু থেকে রক্ত বন্ধকরণের জন্য জরায়ুর ভিতরে ‘বেলুন টেমপোনেড’ ব্যবহার করা যেতে পারে।

৮. শিশুর জন্য গর্ভফুলের নাড়ি থেকে রক্তের স্যাম্পল নিয়ে ডেঙ্গুরোগ আছে কি না তা নির্ণয় করতে হবে এবং শিশুকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।

Facebook Comments