জাতির উদ্দেশে জিএম কাদেরের সতর্কতামূলক ভিডিও বার্তা

মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে দেশ জাতির উদ্দেশে সতর্কতামূলক ভিডিও বার্তা দিয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের।
করোনাভাইরাসের পরিস্থিতি সম্পর্কে এবং তা কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে- এ নিয়ে রাজধানীর উত্তরার বাসা থেকে এ ভিডিও বার্তা দেন। এর আগে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে দলের সভা-সমাবেশসহ সব ধরনের কর্মসূচি স্থগিত করেন।
ভিডিও বার্তায় জাপা চেয়ারম্যান করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় নিজেদের নিরাপদে বাসাবাড়িতে যতটা সম্ভব আলাদা থাকা, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা থাকা এবং একে অপরকে রোগ সম্পর্কে সতর্কবার্তা দেওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। লকডাউন করা হলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার জন্য অর্থ সহায়তা, পরিস্থিতি বিবেচনা করে খাবার, ওষুধ ও পানিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ, বিশেষ করে করোনায় আক্রান্ত রোগীকে সাবধানতার সঙ্গে তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি তিনি বিশেষ অনুরোধ জানিয়েছেন। এছাড়া করোনা মোকাবিলায় দলগতভাবে তিনি সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত। এর বিস্তার রোধে জাপার পক্ষ থেকে দেশব্যাপী সচেতনতামূলক কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান জিএম কাদের।তিনি বলেন, এ মুহূর্তে সারা বিশ্বে মহাআতঙ্কের নাম করোনাভাইরাস (কভিড ১৯)। বিশ্বের সঙ্গে আমাদের দেশের মানুষও আতঙ্কিত। সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছেন না, আমরা কোন দিকে যাচ্ছি, ভবিষ্যৎ কী হতে পারে। এ মহামারীর কারণে কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত আমরা হতে পারি।
করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য ক্ষতি তুলে ধরে জিএম কাদের বলেন, এ রোগের মারাত্মক বিষয় হলো যে, এটি খুবই ছোঁয়াছে এবং প্রাণঘাতি। খুব সহজে এ রোগ একজন থেকে আরেকজনের কাছে চলে যায়। খুব দ্রুতই বিস্তার লাভ করে।
তিনি বলেন, এ মহামারি একটি শ্রেণিকে বেশি ঘায়েল করছে। বিশেষ করে যারা বয়োবৃদ্ধ, অসুস্থ, শারীরিকভাবে দুর্বল ও রোগাক্রান্ত তারা যদি এ রোগে আক্রান্ত হয় তাহলে বেশি মারা যাচ্ছে। তবে স্বস্তির বিষয় এই যে সুস্থ সবল মানুষ ও তরুণরা এ রোগে ভালো হচ্ছে। আরেকটি স্বস্তির খবর, বাচ্চারা যারা ৮ থেকে ১০ বছরের নিচে তাদের সাধারণ এ রোগটি কম হচ্ছে। তারপরও বলব, আতঙ্কের কারণ কিছুটা হলেও আছে। তবে এ ভাইরাস নিয়ে আমরা যতটুকু আতঙ্কিত হয়েছি, হয়তো ততটুকু নেই।
আমরা যদি নিজেরা একটু সাবধান হই, অন্যকে সাবধান করি, তাহলে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকানো আমাদের পক্ষে সম্ভব। যেমন নিজের থুথু, লালা, শরিরের নিঃসরণ থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারি, হাত দিয়ে অন্য কাউকে যদি না ধরি, যেখান থেকে রোগটি ছড়ায় মানুষের শরিরে সেসব জায়গা যদি সব সময় পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখি, কাশি দেওয়ার সময় সাবধান হই, তাহলে রোগ বিস্তাররোধ করা সম্ভব। কাশি, হাঁচি দিয়ে কাউকে স্পর্শ না করি, ঘন ঘন হাত নাক মুখ ধৌত করি, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখি তাহলে একজন থেকে আরেকজনের সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের উপসর্গগুলি অনেকটা ইনফ্লোয়েঞ্জের রোগের মতো। সর্দি, কাশি জ্বর আমাদের দেশের কমনরোগ, সব সময় হয় আমরা জানি। চিকিৎসাসেবাও হাতের নাগালে রয়েছে। সর্দি কাশি জ্বর হলেও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা করে ফেলি, ঘুরাঘুরি না করি, একেবারে নিরাপদ দুরত্বে নিজেকে আলাদা করে রাখি, নিজের রোগের চিকিৎসা করি, তাহলে নিজেই সুস্থ হয়ে যাবো। একইসঙ্গে আমার কারণে অন্তত অন্যরা আক্রান্ত হওয়া থেকে বেঁচে যাবেন। যাতে আমার আপনার থেকে এ রোগ মানুষের কাছে না ছড়ায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। স্পষ্টভাবে করোনাভাইরাস না হলেও সর্দি, কাশি জ্বর হলে তাহলে এ সময় সাবধান হই, এ সময় অন্যদের সঙ্গে না মিশি। আইসোলেশনে থাকি তাহলে সবার জন্যই মঙ্গল। আর যদি আক্রান্ত হয়ে যায় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের কাছে তো যেতেই হবে। তার ব্যবস্থাও থাকতে হবে।
আরেকটি বিষয়ে আমাদের সবাইকে সজাগ থাকতে হবে, এগুলো হলো অস্পৃশ্য রোগ, এ রোগ হলে আশে-পাশে ভয়ে কেউ যেতে চাইবেন না, ডাক্তারও তাকে দেখবেন না। এ বিষয়গুলো খুবই দুঃখজনক। কারণ এ রোগটি নিয়ে আতঙ্ক ছড়ানোর কারণে মানুষ গোপন করতে চাচ্ছেন, সঠিক চিকিৎসাও নিতে চাচ্ছে না। জানাতেও চান না, আবার চিকিৎসকরাও চিকিৎসা সেবা দিতে চাচ্ছেন না। এটি আমি মনে করি সব চাইতে দুঃখজনক বিষয়। একটা মানুষের জন্য সবচাইতে মর্মান্তিক ঘটনা। আক্রান্ত ব্যক্তিকে আশে পাশের মানুষ ঘৃণা করছে, দূরে রাখতে চাইছে, সবাই সরিয়ে দিতে চাইছে, সাহায্য চাইলেও সাহায্য পাচ্ছে না এটা অত্যন্ত অমানবিক বিষয়।
তিনি বলেন, আমি মনে করি না যে করোনাভাইরাস নিয়ে এ ধরনের আতঙ্ক আছে। এটা হলেই যে মারা যাবে এমন কোনো কথা নেই। আক্রান্ত একশ দুশ জনের মধ্যে দু-তিনজন মারা যাচ্ছে। কাজেই এ রোগ নিয়ে ভয়ভীতির কোনো কারণ দেখছি না।
সবকিছু চিন্তা করে লকডাউন করা উচিত মন্তব্য করে জাপা চেয়ারম্যান বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউন করা হচ্ছে ইউরোপ আমেরিকাসহ বিশ্বের অনেক জায়গায়। অনেক শহর বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। তার মানে হচ্ছে মুভমেন্ট বন্ধ করলে এটা কারো যদি থাকে তাহলে এ রোগটা ছড়াতে পারবে না।
লকডাউন করতে হলে যে জিনিসটি খুবই দরকার ,পৃথিবীর উন্নত দেশে যেটা করছে সেটা হলো যে লোকগুলোকে আটকে রাখা হচ্ছে তাদের জীবন জীবিকার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। বিশেষ করে আমাদের দেশে সেটা প্রযোজ্য। দিনে এনে যারা দিনে খায়, যারা বাইরে না গেলে কোনো উপায় থাকে না, খেতে পারবে না, পরিবারকে খাওয়াতে পারবে না তাদের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। তাদের অর্থ সহায়তা দিতে হবে। তাছাড়া লকডাউনের কারণে চালডালের টাকা পয়সা থাকলেও ঘরের বাইরে যেতে না পারার কারণে কিনতে পারবে না, এ সময় তাদের পানি খাবার ওষুধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সহায়তা করতে হবে। এ ধরনের সহায়তার হিসাব করেই লকডাউন করা উচিত হবে। না হলে আটকে পড়ে লাভের চেয়ে মানুষের আরো ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকবে। হঠাৎ করে সবকিছু বন্ধ করে দিলাম, মানুষকে বের হতে দেওয়া হচ্ছে না তালে মানুষ এটার কারণে আরো বেশি কষ্ট পাবে। এ থেকে আরো বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
তিনি বলেন, করোনাভাইরাস নিয়ে আমরা সাবধান হবো, নিশ্চই আমরা এটাকে আরো ভালোভাবে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করবো, আমরা চাইবো এ রোগে মানুষ আক্রান্ত না হোক, মৃত্যুর সংখ্যা কোনোভাবেই না বাড়ুক, তবে সবগুলো বিষয়কে যুক্তি দিয়ে আমাকে বিবেচনা করতে হবে।
ওয়াল্ড হেলথ অরগনাইজেশন বলেছে পরীক্ষা-পরীক্ষা এবং পরীক্ষা। আমাদের দেশে যথেষ্ট পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। এখন পরীক্ষা না করে আমি সহজে কাউকে আইডেন্টিফাই করতে পারছি না। এ কারণে রোগটি ছড়ানোর সম্ভাবনা বেশি থাকছে। পরীক্ষা করে তাকে যদি আমি একটু আলাদা রাখতে পারতাম, সুনির্দিষ্টভাবে বুঝতে পারতাম, তাহলে বিষয়টা হয়তো আরো সহজ হতো, পরীক্ষার যন্ত্রপাতি ও উপকরণ আসা পর্যন্ত আমাদের চেষ্টা করতে হবে রোগটি যাতে না ছড়ায়, নিয়ন্ত্রণে থাকে। আর যাদের লক্ষণ দেখা গেছে, তারা যেন নিজেদের আলাদাভাবে রাখেন। আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যাদের পাওয়া যাবে তাদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের দিকে যত্ন নিতে হবে, চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে।
দেশবাসীকে সচেতন ও সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের বেশি সতর্ক হতে হবে। যখনই লক্ষণ প্রকাশ পায়, তাকে আলাদা থাকতে হবে। যেন দুজন দশজনের সঙ্গে মিশলে সবার মধ্যে ছড়িয়ে না যায়। না হলে এতে বৃদ্ধ, অসুস্থ যে কেউ আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে পারেন। কাজেই এক জায়গায় যদি আমরা বসে থাকতে পারি, মুভমেন্ট না করি, তাহলে একসঙ্গে বেশি লোক এ রোগে আক্রান্ত হবে না। একসঙ্গে বেশি লোক আক্রান্তে হলে যেটি সম্ভাবনা থাকে সেটি হলো তাদের মধ্যে যাদের শ্বাসকষ্টে মারা যাওয়ার অবস্থা হয় অক্সিজেন সাপোর্ট দিতে হয়, এসব যন্ত্রপাতি উপকরণ আমাদের দেশে খুব বেশি নেই। উন্নত দেশেও এত সুযোগ সুবিধা দিতে পারে না। সেসব দেশে মানুষ মারা গেছেন। সবকিছু বিবেচনা করে তারা লকডাউন করে যাতে রোগের বিস্তার না ঘটে। আমাদের উচিত পরিস্থিতি বিবেচনা করে সব ধরনের সুবিধা নিশ্চিত করে লকডাউন করা।
আমি বিশ্বাস করি, যে সংকট দেখা দিয়েছে সেই সংকট মোকাবিলায় আমরা সবাই মিলে কাজ করবো। আমি জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে বলতে পারি যে আমরা সচেতনতা সৃষ্টির জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি, মানুষকে সতর্ক করছি। আমরা মানুষের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। যাতে মানুষ সচেতন হয়, সতর্ক হয়। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যাতে বিস্তার না ঘটে। জনগণের জন্য উপকার হয় এমন সবকিছুই আমরা করে যাচ্ছি। তারপরও সরকারের কাছে আমার আহ্বান থাকবে, দলগতভাবে আমাদের সহযোগিতা দরকার হলে আমরা দিতে প্রস্তুত আছি। দেশ ও জাতির কল্যাণে আমরা কাজ করতে চাই। সবাই মিলে এই সংকট থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করতে চাই বলেন জিএম কাদের।

Facebook Comments