ইতিহাসই, তা কেউ মুছে ফেলতে পারে না: প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতি ও কৃষ্টি রক্ষা করে দেশ গঠনে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাঙালির সব অর্জন আন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত উল্লেখ করে দেশ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাবে এমন প্রত্যাশা রাখেন তিনি। বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে একুশে পদক প্রদান অনুষ্ঠান তিনি এসব কথা বলেন।
একুশের চেতনাকে চির জাগ্রত রাখতে জাতীয় পর্যায়ে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দেয়া হয় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদক।
এ বছর ১২ ক্যাটাগরিতে একটি প্রতিষ্ঠান ও ২০ জন গুণি ব্যক্তির হাতে পদক তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পুরস্কার হিসেবে ১৮ ক্যারেটের ৩৫ গ্রাম স্বর্ণ পদক, চেক ও একটি সম্মাননাপত্র দেয়া হয়।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে একুশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি এনে দিয়ে উল্লেখ করে সব সংগ্রামে জাতির পিতার অবদানের কথা স্মরণ করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণে মাতৃভূমিকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে সবার সহযোগিতা চান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিরবচ্ছিন্ন অবদানের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৪৮ সাল থেকেই জাতির পিতা ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনেও তিনি ভূমিকা রেখেছেন। তবে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো- এক সময় তার নাম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ইতিহাস ইতিহাসই, তা কেউ মুছে ফেলতে পারে না। ১৯৪৮ সালে বঙ্গবন্ধু যখন ভাষা আন্দোলন শুরু করেন, তখন থেকেই পাকিস্তানি বাহিনী তার ওপর নজরদারি ও তার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন লিখতে শুরু করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পৃথিবীর কোনও দেশেই কোনও নেতার বিরুদ্ধে লেখা গোয়েন্দা প্রতিবেদন কেউ প্রকাশ করেনি। আমি এটা করেছি। কারণ ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, সবকিছু থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার একটা চেষ্টা করা হয়েছে দীর্ঘ ২১ বছর। তাই আমি চেয়েছি, সত্যটা মানুষের জানা উচিত। এই গোয়েন্দা প্রতিবেদনের এর চার খণ্ড বই আকারে প্রকাশ হয়েছে। পঞ্চম খণ্ড প্রকাশ হচ্ছে। মোট ১৪ খণ্ড প্রকাশ করা হবে। বাংলাদেশের যে ইতিহাস, তার বিরাট অংশ এই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে পাওয়া যায়।
দেশভাগের পরপরই ভাষা নিয়ে ষড়যন্ত্র হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ১৯৪৭ সালে করাচিতে শিক্ষা সম্মেলন হয়, সেখানেই সিদ্ধান্ত হয় যে- পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। তখন থেকেই কিন্তু আন্দোলনের সূত্রপাত। তখনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের বাসায় মিছিল নিয়ে যায় ও প্রতিবাদ জানিয়ে আসে। এরপর ১৯৪৮ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনে ভূমিকা রাখেন। এরপর থেকেই গোয়েন্দারা তার নামে গোপন প্রতিবেদন লিখতে শুরু করে।
একুশে পদক ভূষিত হলেন যারা- ভাষা আন্দোলনে প্রয়াত আমিনুল ইসলাম বাদশা (মরণোত্তর), সঙ্গীতে বেগম ডালিয়া নওশিন, শঙ্কর রায় ও মিতা হক, নৃত্য গোলাম মোস্তফা খান, অভিনয়ে এস এম মহসীন, চারুকলায় অধ্যাপক শিল্পী ড. ফরিদা জামান, মুক্তিযুদ্ধে প্রয়াত হাজি আক্তার সরদার (মরণোত্তর), আবদুল জব্বার (মরণোত্তর), ডা. আ আ ম মেসবাহুল হক ওরফে বাচ্চু ডাক্তার (মরণোত্তর), সাংবাদিকতায় জাফর ওয়াজেদ (আলী ওয়াজেদ জাফর), গবেষণায় ড. জাহাঙ্গীর আলম ও হাফেজ কারি আল্লামা সৈয়দ মোহাম্মদ ছাইফুর রহমান নিজামী শাহ, শিক্ষায় অধ্যাপক ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া, অর্থনীতিতে অধ্যাপক ড. শামসুল আলম, সমাজসেবায় সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, ভাষা ও সাহিত্যে ড. নুরুন নবী, সিকদার আমিনুল হক (মরণোত্তর) ও বেগম নাজমুন নেসা পিয়ারি এবং চিকিৎসায় অধ্যাপক ডা. সায়েবা আখতার। গবেষণায় প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে একুশে পদক দেয়া হয় বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটকে।
পদক বিজয়ীরা প্রত্যেকে নিজ নিজ এবং মরণোত্তর পদক বিজয়ীদের পক্ষে তাদের পুত্র ও কন্যাগণ প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পদক গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের পক্ষে পদক গ্রহণ করেন এর মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ।
৫ ফেব্রুয়ারি (বুধবার) বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০২০ সালের একুশে পদক বিজয়ী হিসেবে ২০ ব্যক্তি এবং একটি প্রতিষ্ঠানের নাম ঘোষণা করা হয়।
সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদের সভাপতিত্ব অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ আবু হেনা মোস্তফা কামাল। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বিজয়ীদের সাইটেশন পাঠ করেন।
মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাবৃন্দ, বিচারপতিবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, তিন বাহিনী প্রধানগণ, সরকারের ঊর্ধ্বতন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ, বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যগণ, কবি, সাহিত্যিক, লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক সহ বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ, অতীতে একুশে পদক বিজয়ীগণ, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক ও সংস্থার প্রধান এবং আমন্ত্রিত অতিথিগণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

Facebook Comments