কর বৃদ্ধি ছাড়াই রাজস্ব আয় বাড়াবো: মেয়র তাপস

দেশবাংলা ডেস্ক 

অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর হয়ে পড়া ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে (ডিএসসিসি) স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ নিয়েছেন মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস।

তিনি জানিয়েছেন রাজস্ব আয় বাড়ানোর মাধ্যমে ঢাকা দক্ষিণকে স্বাবলম্বী করে তোলা হবে। তবে নতুন করে কোনও কর বৃদ্ধি করা হবে না। আমাদের যে পরিকল্পনা রয়েছে তাতে কর বৃদ্ধি ছাড়াই রাজস্ব আয় বাড়বে।

নিজ কার্যালয়ে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মেয়র এসব কথা বলেন। এসময় মেয়র সংস্থার রাজস্ব আয় বৃদ্ধিসহ নানা বিষয়ে তার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে।

রাজধানীর সড়ক নির্মাণ ও সংস্কার করে থাকে সিটি করপোরেশন। কিন্তু সড়ক ব্যবহারের জন্য গণপরিবহন থেকে রাজস্ব আদায় করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। এক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে অকট্টয় ব্যবস্থা চালুর কথা বলা হয়ে আসছে। সেটি চালুর বিষয়ে কোনও উদ্যোগ নেওয়া হবে কিনা?

ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, সিটি করপোরেশনের সেবার পরিধি কিন্তু অনেক বিস্তৃত। আমরা সেবার পরিধি আরও বিস্তৃত করতে চাই। তার সঙ্গে সেবার বিপরীতে রাজস্ব আয়ের যে খাতগুলো আছে সেগুলোকে আমরা প্রয়োগ করতে চাচ্ছি। আমরা আরও নতুন ২৬টি খাত রয়েছে সেগুলো থেকে রাজস্ব আহরণ করবো। এখানে কোনও কর বৃদ্ধি ছাড়াই আমাদের রাজস্ব আহরণ অনেক বৃদ্ধি পাবে। এতদিন আইনে থাকা স্বত্বেও সিটি করপোরেশনের ইতিহাসে বিভিন্ন খাত থেকে কোনও আয় করা হয়নি। মাত্র ৮টি খাত থেকে রাজস্ব আহরণ করা হতো। এ কারণে জনগণের উপর একটা বাড়তি চাপ পড়তো। যেহেতু খাত কম সেহেতু ওই খাতগুলোর উপরেই বাড়তি চাপ পড়তো। একটি বড় অংশ হচ্ছে অকট্টয়। এখানে ঢাকা সিটি করপোরেশনের সকল রাস্তাঘাট মেরামত বা সংস্কারের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের ওপর বর্তায়। সকল রাস্তাঘাট আমরা নির্মাণ ও সংস্কার করে থাকি। এর পেছনে অনেক টাকা ব্যয় হয়। পাশাপাশি এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্যও সরকার থেকে অনেক বরাদ্দ আনতে হয়। আমরা রাস্তা তৈরি করি আর অন্যান্য সংস্থা সেগুলো নষ্ট করে। বিশেষ করে বিআরটিএ, যারা সকল যানবাহন থেকে কর নিয়ে থাকে। তারা সেই করটা কী কারণে নেয়? আপনি দেখবেন শুধু লাইসেন্স ফি? তা কিন্তু নয়, ফিটনেস ফি? তাও নয়। এই সড়কগুলো ব্যবহারের জন্যও ফি নেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে আমাদের কোনও রাজস্ব দেওয়া হয় না। আমরা মনে করি এই খাতের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ আমাদের পাওয়া উচিত। আমাদের অকট্টয় নামে সামান্য পরিমাণ অর্থ দেওয়া হয়, যা খুবই নগণ্য। আমরা এখানে নগণ্য পরিমাণ চাই না। আমরা মনে করি এর বৃহৎ অংশ সিটি করপোরেশনকে দেওয়া উচিত।

মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস সিটি করপোরেশনের ইতিহাসে আপনি সবচেয়ে বড় বাজেট দিতে যাচ্ছেন। অতীত ইতিহাসে আমরা এও দেখেছি সিটি করপোরেশন যে বাজেট ঘোষণা করে তার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয় না। এক্ষেত্রে আপনি কতটুকু আশাবাদী?

ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, এক সময় করপোরেশনের গৎবাঁধা খাতগুলো থেকে যে বৃহৎ অংশ দেখানো হতো আমরা কিন্তু সেগুলো দেখাইনি। আমাদের যে বৃদ্ধি সেটি হচ্ছে খুবই যৌক্তিক বৃদ্ধি। আমরা আগে যে খাতগুলো থেকে কোনও টাকা পাইনি এখন সেই খাতগুলো থেকে সেবা নিশ্চিত করা সাপেক্ষে কর নেবো। সেখানে আমার মনে হয় কোনও রকম কর বৃদ্ধি ছাড়াই রাজস্ব আহরণ বাড়বে। আমরা আশা করছি যে পরিমাণ রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি তার বড় অংশেই প্রাপ্ত হবো। আমরা ৯০ ভাগের ঊর্ধ্বেই প্রাপ্তি আশা করছি।

বিগত বছরগুলোতে মশার ওষুধ সরবরাহের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট থেকে মুক্তি দিতে সরকার সিটি করপোরেশনকেই ওষুধ আমদানির লাইসেন্স দিয়েছে। তখন যে সমস্যার কারণ এই লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে এবছর ঠিক একই সমস্যা আবার দেখা দিয়েছে। লাইসেন্স অনুযায়ী সিটি করপোরেশন ওষুধ আমদানি করতে পারলেও তার ফর্মুলেশন করতে পারছে না। ফলে আবারো পুরানো বৃত্তের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। এক্ষেত্রেও সিন্ডিকেটের কারণে সিটি করপোরেশন এখনও আমদানিকৃত ওষুধ ফর্মুলেশন করতে পারেনি। ওষুধ ফর্মুলেশনের এই প্রক্রিয়া সিটি করপোরেশন সম্পন্ন করার অনুমতি সরকার থেকে চাইবেন কিনা?

ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন,পূর্বে অনেকগুলো বিষয় ছিল। মশা মারার জন্য যে কীটনাশক আমদানি করা হতো সেখানে সিটি করপোরেশন অন্যদের উপর নির্ভরশীল ছিল। সেখানে দেখা গেছে একটা বড় ফাঁকি থাকতো। দ্বিতীয়ত যে মিশ্রণ করা হতো সেখানেও দেখা যেতো একটি বড় সিন্ডিকেট বা দুর্নীতি থাকতো। এবার আসলে সেগুলো কোনওটাই নেই। সরকার সিদ্ধান্ত দিয়েছে আমরাই মূল কীটনাশকটা নিজেরাই আমদানি করতে পারছি। সেটার সুফল জনগণ পাচ্ছে এবং এর মান খুবই ভালো। তৃতীয়ত মিশ্রণ যেটা করা হয় আমি এসেই দেখেছি যেই দামেই মিশ্রণ করা হচ্ছে সেটা অত্যন্ত উচ্চ মূল্য। আমরা সেই দরপত্র বাতিল করেছি। আমি নিজেই সক্ষমতা যাচাই করার জন্য দুটি কারখানা পরিদর্শনে করেছি। আগের যে দর ছিল তার চেয়ে অনেক কম দরেই আমরা পাচ্ছি।

আমরা নিজেরা তো সব চাইলে সব করতে পারি না। কিছু তো সরবরাহ নিতে হবে, সংগ্রহ করতে হবে। কারণ আমরা যদি এসব দিকে বেশি নিবেদিত হয়ে যাই তাহলে সেবা দিতে পারবো না। অমাদের মূল কাজ সেবা দেওয়া। সেই সেবা দেওয়ার জন্যই আমরা যে কর্মকৌশল নিয়েছি তার সুফল এরই মধ্যে ঢাকাবাসী পাচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আরও পাবে। এখন যেহেতু সিন্ডিকেট নেই, মোটামুটি দুর্নীতিমুক্ত একটা পরিবেশ সৃষ্টি করতে পেরেছি। মানুষকে বার্তা দিতে পেরেছি এখানে দুর্নীতির কোনও জায়গা হবে না। আমার মনে হয় পর্যায়ক্রমে এর স্বচ্ছতা আরও বৃদ্ধি পাবে। আমরা এগুলো পরিপালন করার চেষ্টা করছি। এটা আরও স্বচ্ছতা পেলে আমার মনে হয় এই দৌরাত্ম্যগুলো নির্মূল হবে।

হোল্ডিং ট্যাক্স আদায়ে পুরাতন ও নতুন বাড়ি মালিকদের মধ্যে বৈষম্য রয়েছে। পুরাতন বাড়ি মালিকরা ৩০ বছর আগের রেশিও অনুযায়ী ট্যাক্স পরিশোধ করে থাকনে। আর নতুন বাড়ি মালিকরা বর্তমান রেশিও অনুযায়ী ট্যাক্স পরিশোধ করে থাকেন। এক্ষেত্রে রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে হোল্ডিং ট্যাক্স পুন:মূল্যায়নের জন্য আপনি কোনও উদ্যোগ নিবেন কিনা?

ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, আমি আমার নির্বাচনি ইশতেহারে বলেছি কোনও কর বৃদ্ধি হবে না। সুতরাং আমরা কোনও কর বৃদ্ধি করছি না। সেক্ষেত্রে হোল্ডিং ট্যাক্স আমাদের কর আদায়ের একটি বড় অংশ। সেখানে আমরা নতুন করে মূল্য নির্ধারণের উদ্যোগ এবছর নিচ্ছি না। এবছর যেহেতু করোনা মহামারি সবাই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, সেক্ষেত্রে তারা নতুন করে কোনও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হোক সেটা চাই না। আপনারা জানেন এসব হোল্ডিংয়ের যারা মালিক তারা এর বড় একটি অংশ ভাড়া দিয়ে থাকেন। তারা কিন্তু করোনার মহামারির কারণে ভাড়াও কমে গেছে, ভাড়া প্রাপ্তিও কমে গেছে। সব দিক দিয়ে আমরা নতুন করে মূল্যায়ন করছি না। তবে এখানে আগের নিয়মে অনেক বড় ফাঁক রয়েছে। এখানে দুর্নীতিরও অনেক আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। দেখা গেছে তখন যে বাড়িটি এক তলা হয়েছে তার এক তলারই মূল্যায়ন হয়েছে। এখন সেখানে ৪ তলা ভবন হয়েছে বাকি তিন তলার মূল্যায়ন হয়নি। আমরা এই বিষয়গুলো খতিয়ে দেখবো। এগুলো আমরা জরিপ করছি। এই ফাঁকগুলো আমরা বন্ধ করে দেবো। যাতে সবার একটা ন্যায্যতা থাকে। তবে নতুন করে আমরা কোনও কর বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিচ্ছি না।

রাজধানী ঢাকাকে রিকশার নগরী বলা হচ্ছে। আর যানজটের জন্য এই রিকশাকেই দায়ী করা হচ্ছে। আপনি নতুন বাজেটে রিকশায় করারোপ করার উদ্যোগ নিয়েছেন। সেক্ষেত্রে যানজট নিরসনে রিকশা কমানোর কোনও উদ্যোগ নেওয়া হবে কিনা?

ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন,রিকশা আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। আমি মনে করি রিকশা ঢাকা শহরের একটা বড় বৈশিষ্ট্য। এখানে রিকশা থাকবে। কিন্তু সেটা একটা নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় চলাচল করবে। আমাদের যারা রিকশাচালক আছে তারা গণপরিবহনের একটা বড় ভূমিকা পালন করে থাকেন। কিন্তু তারা অবহেলিত নিষ্পেষিত। তারা অবজ্ঞার শিকার। আমরা এটাকে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আনার উদ্যোগ নিয়েছি। ঢাকা শহরের সড়কগুলোর কার্যকারিতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছি। কিছু রাস্তা থাকবে দ্রুতগতির যানবাহনের জন্য। কিছু সড়ক থাকবে যেখানে রিকশা চলবে। ধীরগতির যানবাহনে আমরা শহরকে উপভোগ করতে পারি। কিছু সড়ক থাকে যেখানে শুধু হেঁটে চলাচল হবে। আমরা সেখানে আমাদের সড়কগুলোর কার্যকারিতা নির্ণয় করে আলাদা করে দেবো। সেখানে রিকশা একটি বড় ভূমিকা পালন করবে। এটা ধীরগতির যানবাহন হলেও উপভোগ্য একটি যানবাহন। আমরা এর জন্য নিবন্ধন প্রক্রিয়াটাকে নতুন করে স্বচ্ছ করে দিচ্ছি। আমরা ঢাকা শহরে যারা রিকশা চালক আছেন তার মধ্যে আমরা সুনির্দিষ্ট একটি সংখ্যা নির্ধারণ করে দেবো। আমাদের ৫০ হাজারের মতো রিকশার নিবন্ধন রয়েছে। কিন্তু চলাচল করে আরও কয়েকগুণ বেশি। আমরা নির্ধারণ করবো কতগুলো রিকশা চলবে এবং কোন কোন সড়কে চলবে।

ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, আমরা মনে করি সন্ধ্যা ৬টার পরে সব সড়কেই চলতে পারে। দিনের বেলায় গণপরিবহন যেসব রাস্তায় চলে সেখানে হয়তো রিকশা চলবে না। ধীরগতির এবং দ্রুত গতির যানবাহন আমরা এক রাস্তায় আনবো না। এভাবে আমরা পুরো বিষয়টি মহাপরিকল্পনায় ঢেলে সাজাচ্ছি। আমার মনে হয় ঢাকা নগরীকে মহাপরিকল্পনার আওতায় নিয়ে আসতে পারলে যানবাহন ব্যবস্থাটাকে আমরা ঢেলে সাজাতে পারবো। ঢাকা নগরী একটি সচল ঢাকা হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে। যেখানে আমার এই ঐতিহ্যের রিকশাও সুন্দরভাবে চলবে, পায়ে হেটেও আমরা চলবো এবং গণপরিবহন ও মেট্রো রেলেও চলবো।

Facebook Comments