পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘বাকরখানি’

মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ

জবি প্রতিনিধি

ভোজন রসিক মানুষের জন্য বাকরখানি একটি অনন্য নাম। এটি পুরান ঢাকার ঐতিহ্যের প্রতীক। বর্তমানে পুরো বাংলাদেশেই এই শুকনা খাবারটি পাওয়া যায়। বাকরখানি উৎপত্তি স্থান আফগানিস্তানে হলেও রাশিয়া, তুর্কিস্তান, ভারত, পাকিস্তানেও পাওয়া যায় এই মুখোরোচক খাবারটি। মির্জা আগা বাকেরের হাত ধরেই ঢাকায় এর প্রচলন ঘটে। ধরা হয় আজ থেকে প্রায় দুইশত থেকে আড়াইশত বছরের পুরনো খাবার এটি। পুরাণ ঢাকার লালবাগ কেল্লার সামনে ‘বাকরখানি’র প্রথম দোকান গড়ে উঠে। এখনো এই ঐতিহ্য তারা ধরে রেখেছেন। ‘বাকরখানি’ কে ‘শুকা’ বা নিমশুকা (শুকনা) রুটিও বলা হয়।বাকরখানি রুটির নামের পেছনে আছে এক করুণ ইতিহাস।

জনশ্রুতি অনুসারে, জমিদার আগা বাকের তথা আগা বাকির খাঁর নামানুসারে এই রুটির নামকরণ করা হয়েছে। তখনকার নবাবরা এই বাকরখানি খেতো দুধ দিয়ে। তাছাড়া এর নামের পিছনে রয়েছে এক প্রেম কাহিনী। এর আগা বাকের খানের নামানুসারে বরিশালের পূর্বনাম বাকেরগঞ্জ করা হয়েছিল। ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রামে ‘বাকরখানি’ পাওয়া যায়।

আধুনিক সময়ে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বাকরখানি বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। দেশের সীমানা পেরিয়ে পুরান ঢাকার বিখ্যাত এই বাকরখানি আজ যাচ্ছে কুয়েত, কাতার, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরবসহ ইউরোপ আমেরিকার কিছু দেশেও রপ্তানি হচ্ছে এই বাকরখানি।

পুরান ঢাকার ইতিহাস থেকে জানা যায়, ঐতিহ্যবাহী এই বাকরখানি তৈরির পেছনে রয়েছে এক অমর প্রেমকাহিনী। এর নামকরণের গল্পটা বেশ দারুণ। আগা বাকের নামে তুর্কিস্তানের এক বালক ক্রীতদাস হয়ে এসেছিল এ দেশে। তখনকার বাংলার সুবেদার নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ সুদর্শন এ বালককে কিনে নিয়েছিলেন। আগা বাকেরের বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ হয়ে নবাব তার পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন। আগা বাকের প্রথমে চট্টগ্রামে ফৌজদারের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর দীর্ঘ সময় তিনি বাকলা চন্দ্রদ্বীপের শাসনকর্তা ছিলেন। তার নামানুসারেই বাকেরগঞ্জ জেলার নামকরণ হয় যাকে আমরা এখন বরিশাল নামে চিনি। আগা বাকের ভালোবেসেছিলেন সুন্দরী নর্তকী খনি বেগমকে। তার প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্ব্বী ছিলেন কোতয়াল জয়নুল খাঁ। এই নর্তকীকে ঘিরে আগা বাকের ও জয়নুল খাঁর দ্বন্দ্ব শুরু হয়। নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ এই দ্বন্দ্বের কারণে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে বাকেরকে এক বাঘের খাঁচায় নিক্ষেপ করেছিলেন।

শক্তিধর বাকের বাঘকে হত্যা করে খাঁচা থেকে বীরের মতো বেরিয়ে এসেছিলেন। ততক্ষণে খনি বেগমকে অপহরণ করে দুর্গম চন্দ্রদ্বীপের গহীনে পালিয়ে গিয়েছিলেন জয়নুল খাঁ। আগা বাকের প্রেমিকাকে উদ্ধারে চন্দ্রদ্বীপে উপস্থিত হলে জয়নুল খাঁ খনি বেগমকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। খনি বেগমকে না পেলেও প্রেমের স্মৃতি চিরজাগরুক রাখতে আগা বাকের নতুন ধরনের শুকনো রুটি তৈরি করিয়ে তার নাম দিয়েছিলেন বাকেরখনি। পুরান ঢাকার প্রখ্যাত লেখক নাজির হোসেনের ‘কিংবদন্তির ঢাকা’ গ্রন্থেও বলা হয়েছে এ কথা। সাধারণ মানুষের উচ্চারণে যা আজ বাকরখানি হয়ে গেছে। নবাবদের এই খাবার বাকরখানি তৈরি হতো মালাই-মাখন দিয়ে অতীতে ময়দার সঙ্গে দুধের মালাই ও মাখন মিশিয়ে খামির তৈরি করে বাকরখানি বানানো হতো। সে সময় এটা ছিল নবাব আর আমিরদের প্রিয় খাবার। মালাই-মাখনের বাকরখানি এখন আর তৈরি হয় না। তবে ঢাকার অনেক পুরনো খানদানি পরিবার বিয়ে বা সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য আগাম অর্ডার দিলে মালাই-মাখনের বাকরখানি এখনো সরবরাহ করা হয়ে থাকে।আগে ঢাকার বনেদি পরিবার নিজেদের বাড়িতেই বাকরখানি তৈরির আয়োজন করতেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেলে দুধের মালাইয়ের পরিবর্তে বাকরখানিতে ডালডা ও তেল ব্যবহারের প্রচলন হয়। এটি তৈরির জন্য প্রথমেই একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় ময়দা, সামান্য পানি এবং ডালডার সমন্বয়ে খামির তৈরি করা হয়। এবার তৈরিকৃত খামির থেকে কেটে ছোট ছোট গোলাকার কোয়া তৈরি করা হয়। এবার বেলুন দিয়ে কাঠের পিঁড়িতে কোয়াটি দিয়ে গোলাকার কাঁচা রুটি তৈরি করা হয়। কাঁচা রুটির মাঝখানে ছুরি দিয়ে লম্বা করে তিনটি দাগ কেটে দেওয়া হয়। এবার এর একপাশে পানির সামান্য প্রলেপ দিয়ে তন্দুরের দেয়ালে আটকে দেওয়া হয়। ৫ থেকে ৭ মিনিটে তৈরি হয়ে যায় বাকরখানি।

যুগের পরিবর্তনে মানুষের খাদ্যাভ্যাসে আমুল পরিবর্তন আসলেও স্থান ও স্বাদ ভেদে কিছু খাবার রয়েই যায়। তেমনি একটি খাবার বাকরখানি। দুধ, চিনির পানি, চা, যে কোনো ডাল, মাংস ও তরকারি দিয়ে খাওয়া যায় এই শুকনো মুখোরোচক খাবারটি। তবে অনেকে শুধু দুধ চিনি দিয়ে খেতে পছন্দ করে, আমার অনেকে চায়ের সাথে খেতে পছন্দ করে। ময়দা, ডালডা, চিনি, পানি, লবন, সয়াবিন তেল দিয়ে রুটির মতো খামির তৈরী করে তান্দুরে সেঁকে তৈরী করা হয় মুচমুচে সুস্বাদু বাকরখানি। নোনতা, কাবাব, ছানা, পনির, চিনি, কিমা ও নারিকেলের সংমিশ্রণেও তৈরি করা যায় বাকরখানি। এ ছাড়া গরু ও খাসির মাংস দিয়েও এক ধরনের বাকরখানি তৈরি করা যায়। ঘি দিয়েও বিশেষ যত্নের সঙ্গে এই বাকরখানি তৈরি করা হয়ে থাকে। বাকরখানি সাধারণত দুধ চায়ের সাথে খাওয়া বেশি জনপ্রিয়। এর পরেই আদি ঢাকাইয়াদের বাকরখানি পছন্দ মিষ্টি ও মিষ্টিজাতীয় খাবারের সাথে তন্মধ্যে ফিরনী অন্যতম। বাকরখানি ঝাল গরুর মাংসের সাথেও বেশ জনপ্রিয়। নোনতা বাকরখানি সাধারণত ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য তৈরি করা হয়।

লালবাগ কেল্লার কাছেই প্রথম বাকরখানির দোকান গড়ে উঠেছিল। এরপর পুরান ঢাকার চানখাঁরপুল, আগা নবাব দেউড়ি, কোতোয়ালি, চকবাজার, বংশাল, হাজারীবাগ ও সূত্রাপুর এলাকায় বিস্তার লাভ করে। পুরনো ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের দুই পাশেও রয়েছে বাকরখানির অনেক দোকান। এসব দোকানের বাকরখানি স্বচ্ছ পলিথিনের প্যাকেটে ভরে ধানমন্ডি, উত্তরা, বনানী, গুলশানসহ রাজধানীর এলাকার সাধারণ দোকানে ও ডিপার্টমেন্ট স্টোরে সরবরাহ করা হয়। বাকরখানি চায়ের সঙ্গে খাওয়ার প্রচলন পুরান ঢাকায় বেশি। এ ছাড়াও গরু, খাসি, মুরগির মাংসের সঙ্গেও বাকরখানির স্বাদ অতুলনীয়। অনেক জায়গায় ক্ষীর ও পায়েসের সঙ্গেও পরিবেশন করা হয় বাকরখানি। বাকরখানি মূলত কেজি দরে বিক্রি করা হয়। ৩৫ থেকে ৪০টি বাকরখানি প্রতি কেজিতে পাওয়া যায়। প্রতি কেজির মূল্য ১৫০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২০০ টাকা। বাকরখানি সাধারণত ঈদের সময় স্পেশাল অর্ডার দিয়ে তৈরি করা হয়।মজাদার এই বাকরখানি পুরান ঢাকার সর্বত্রই পাওয়া যায় যা পিস্ ও কেজি হিসেবে বিক্রি হয়।

Facebook Comments