করোনার সময় পড়ালেখা

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

এটি এমন একটি সময় যখন মানুষজন করোনাভাইরাস ছাড়া আর কিছু নিয়ে কথা বলছে না। এর মাঝেই পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ ঘরের ভেতর স্বেচ্ছাবন্দি হয়ে আছে। এখন অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে, কখন ঘর থেকে বের হয়ে আবার আগের জীবনে ফিরে যাবে।

আমি ধীরে ধীরে খবর পেতে শুরু করেছি যে,ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার বিষয়টি নিয়ে ঘরে ঘরে বাবা-মায়েদের ভেতর এক ধরনের দুর্ভাবনা জমা হতে শুরু করেছে। যদি এই বিষয়টা বিচ্ছিন্নভাবে দুই-এক জায়গায় হতো তাহলে সেই এলাকার বাবা-মায়েরা দুর্ভাবনা করতে পারতেন। কিন্তু যেহেতু এই করোনাবিপর্যয় শুধু দু-এক জায়গায় নয়, এমনকি শুধু সারাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই হচ্ছে তাই আমি মনে করি ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে বাবা-মায়েদের আলাদাভাবে দুর্ভাবনা করার কোনো কারণ নেই।

এই করোনার কালে বাবা-মায়েরা যদি লেখাপড়ার আসল উদ্দেশ্যটা কী সেটা নিয়ে একটু চিন্তাভাবনা করেন, আমার মনে হয় তাহলে তাদের দুর্ভাবনাটা আরও কমে যাবে।। প্রতিদিনই খবরের কাগজে দেখছি পৃথিবীর কোনো না কোনো দেশ তাদের ঘরবন্দি মানুষদের একটু একটু করে বাইরে আসতে দিচ্ছে। জ্বর হয়েছে বলে মাকে জঙ্গলে ফেলে দিয়ে আসার মতো ঘটনা পত্রিকায় আসছে না। কিছুদিন থেকে আমিও লেখাপড়া নিয়ে টেলিফোন পেতে শুরু করেছি। গুরুত্বপূর্ণ মিটিং করা খুবই সহজ হয়ে গেছে শুধু একটা শার্ট পরতে হয়, শেভ না করলেও কেউ কিছু মনে করে না।

তবে কিছু কিছু বাক্যে আমি এখনও অভ্যস্ত হতে পারিনি- কেউ যখন বলে, ‘স্যার আপনাকে দেখে খুব ভালো লাগছে!’ আমি তখন প্রবলভাবে আপত্তি করে বলি, ‘না এটা মোটেও দেখা না, সামনাসামনি না দেখা পর্যন্ত আমি সেটাকে মোটেও দেখা বলতে রাজি না।’ ছোট একটা স্ক্রিনে আধাযান্ত্রিক গলার স্বর শুনে আমি সন্তুষ্ট হতে পারব না। সারা পৃথিবীর মানুষের মতো আমিও বুভুক্ষের মতো অপেক্ষা করছি কখন আমরা আবার আগের জীবন ফিরে পাব, একটা শিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে পারব এবং সে জন্য বাসায় এসে টানা বিশ সেকেন্ড সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে না!

কোনো কিছু জানা বা শেখা লেখাপড়ার আসল উদ্দেশ্য না। লেখাপড়ার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে একজন ছেলে বা মেয়ের ভেতরে জানা কিংবা শেখার ক্ষমতা তৈরি করে দেয়া। যার ভেতরে জানা বা শেখার ক্ষমতা আছে সে যেকোনো কিছু নিজে নিজে জেনে নিতে পারবে বা শিখে নিতে পারবে। মনে আছে আমি যখন সেই নব্বইয়ের দশকে দেশে ফিরে এসে কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের দায়িত্ব নিয়েছিলাম তখন দেশে কম্পিউটার এত সহজলভ্য ছিল না। যখন নূতন ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসে ভর্তি হতো তখন পুরো ক্লাসে অল্প কয়েকজনকে পাওয়া যেত যারা আগে কম্পিউটার ব্যবহার করে এসেছে। কম্পিউটার ল্যাবে তাদের কম্পিউটার ব্যবহার করা দেখে অন্যরা একইসাথে হতাশা এবং হীনমন্যতায় ভুগতো। আমি তখন ছেলেমেয়েদের বলতাম, ‘যাদের দেখে তোমরা এত নার্ভাস হয়ে আছো তাদের সাথে তোমাদের পার্থক্য মাত্র এক সপ্তাহ।’ সত্যি সত্যি সপ্তাহ না ঘুরতেই দেখা যেত কম্পিউটার চালাতে সবাই সমান পারদর্শী। সবারই শেখার ক্ষমতা আছে, সবাই শিখে নিয়েছে।

কাজেই ঘরবন্দি হয়ে থাকা যেসব বাবা-মা নিজেদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে দুর্ভাবনা করছেন তাদের কাছে আমার একটা মাত্র প্রশ্ন, আপনার ছেলেমেয়েদের কি জানা এবং শেখার ক্ষমতা আছে? নিশ্চয়ই আছে, তাহলে তাদের নিয়ে দুর্ভাবনা করার কোনো কারণ নেই। স্কুল-কলেজ বন্ধ বলে যেটুকু ক্ষতি হয়েছে বা হচ্ছে সেটা পুষিয়ে নেয়া তাদের জন্য বিন্দুমাত্র কঠিন কোনো ব্যাপার নয়।

এবারে একটু কঠিন প্রশ্ন করি। একটা ছেলে বা মেয়ের জানা বা শেখার ক্ষমতা নেই, এমনটি কি কখনও হতে পারে? মানুষ অন্য প্রাণী থেকে আলাদা তার একটি মাত্র কারণ, তাদের নূতন কিছু জানা বা শেখার ক্ষমতা আছে। কাজেই সব শিশুই কমবেশি জানা এবং শেখার ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। ঘরে খুব কমবয়সী শিশু থাকলে সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়, আমরা তখন দেখি সেই শিশুটি কী অবিশ্বাস্য কৌতূহল নিয়ে সবকিছু যাচাই করে যাচ্ছে এবং সেটার সামাল দিতে গিয়ে বাবা-মায়েরা কীভাবে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। খুবই একটা দুঃখের ব্যাপার হয় যখন বাবা-মায়েরা ছোট শিশুর কৌতূহল না মিটিয়ে তাকে ধমক দিয়ে শাসন করে তার শেখার আগ্রহটি নষ্ট করে দেন।

আমার মতে সেটি আরও বেশি হৃদয়বিদারক হয় যখন বাবা-মায়েরা পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাবে সেই আশা করে তাদের ছেলেমেয়েদের কোচিং করতে পাঠান। তখন একটু একটু করে একটা ছেলে বা মেয়ের জানা এবং শেখার ক্ষমতা নষ্ট হতে থাকে। একসময় সেই ছেলে বা মেয়েটি আর নিজে নিজে শিখতে পারে না, তার ভেতরে কোনো আত্মবিশ্বাস থাকে না, কোনো একটা কিছু জানার জন্য বা শেখার জন্য সে সবসময় অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

করোনাদুর্ভোগ নিয়ে আহ্লাদিত হওয়ার কিছু নেই, শুধু একটি ব্যাপারে আমার একটুখানি আনন্দ। এই দেশের লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ের এখন কোচিং নামের সেই ভয়ঙ্কর বিভীষিকাতে গিয়ে নিজেদের সৃজনশীলতাটুকু নষ্ট করতে হচ্ছে না। কে জানে হয়তো অনেক ছেলেমেয়ে নিজেদের পাঠ্যপুস্তক খুলে নিজেরা নিজেরা পড়তে গিয়ে আবিষ্কার করেছে সেটা মোটেও কঠিন কিছু নয়, নিজেরাই পড়ে সব বুঝে ফেলছে। হয়তো তারা অবাক হয়ে ভাবছে, কেউ একথাটি কেন আমাকে আগে বলেনি? তাহলে তো আমি যে সময়টুকু নিজের পছন্দের কাজ করে উপভোগ করতে পারতাম সেই সময়টি কোচিং করে নষ্ট করতাম না। (স্বপ্ন দেখতে সমস্যা কী? এই দেশের ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমি আমার মতো করে স্বপ্ন তো দেখতেই পারি!)

এমন কোনো প্রক্রিয়া কি আছে যেটা করে একটা ছেলে বা মেয়ের জানা এবং শেখার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়া যায়? অবশ্যই আছে এবং সেটা হচ্ছে পড়া। একটা শিশু যখন স্কুলে যাওয়া শুরু করে তখন তার প্রথম কাজটিই হচ্ছে পড়তে শেখা। যে ছেলে বা মেয়ে যত ভালো করে পড়তে শিখে তার শিক্ষাজীবনটি হয় তত সহজ। একটি শিশু যদি তার গুটিকতক পাঠ্যবই ছাড়া আর কিছুই না পড়ে তাহলে তার পড়ার ক্ষমতা বাড়বে কেমন করে? এ দেশের ছেলেমেয়েরা আমার কাছে সবচেয়ে বেশিবার যে অভিযোগটি করেছে সেটি হচ্ছে তাদের বাবা-মায়েরা পাঠ্যবই ছাড়া আর অন্য কোনো বই পড়তে দেন না। এর চাইতে মর্মান্তিক অভিযোগ আর কী হতে পারে? যখন একটি ছেলে বা মেয়ে অনেক বেশি পড়ে তখন সে অনেক অল্প সময়ে বেশি পড়তে শিখে যায়, শুধু তাই নয় কিছু একটা পড়ে তার ভেতরকার বিষয়টা বুঝে ফেলার ক্ষমতাটাও বেড়ে যায়। বেশি গবেষণার প্রয়োজন নেই আমরা যদি আমাদের চারপাশের ছেলেমেয়ের দিকে তাকাই, এক নজর দেখলেই বুঝতে পারব কোন ছেলেটি বা মেয়েটি বই পড়ে আর কে পড়ে না।

করোনাকালের এই ঘরবন্দি দুঃসময়টি তাই হচ্ছে বই পড়ার সময়। সেইসব ছেলেমেয়ে হচ্ছে সৌভাগ্যবান যাদের বাসাভর্তি বই, যারা বই পড়ে শেষ করতে পারছে না। ফেসবুক জাতীয় সামাজিক নেটওয়ার্কগুলো দিনে দিনে আরও অনেক বশি আগ্রাসী হয়ে উঠছে। আমরা বলতে গেলে এখন কোনো মানুষকেই দেখি না যে উদাসমুখে আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছে। আমরা সবসময় দেখি তার হাতে একটা স্মার্টফোন আর সেই স্মার্টফোনের ছোট স্ক্রিনে তার সব মনোযোগ। আকাশকে দেখতে হলেও সে আর সত্যিকার আকাশকে দেখছে না, স্মার্টফোনের স্ক্রিনের ভেতর দিয়ে দেখছে।

অল্প কিছুদিন আগে একটা বড় ইউনিভার্সিটির একজন বড় প্রফেসরের সাথে কথা হচ্ছিল। তিনি তার হাতের দামি স্মার্টফোনটি নাড়িয়ে কথা প্রসঙ্গে বললেন, ‘আজকাল আর মোটা বই পড়তে পারি না, ধৈর্য থাকে না।’ যদি একজন বড় অধ্যাপকের মোটা বই পড়ার ধৈর্য না থাকে, তাহলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কী হবে? আমরা কি আকাশের দিকে তাকিয়ে মাথা চাপড়ে গলা ছেড়ে কাঁদব! কেঁদে কী লাভ হবে?

আমি প্রায় পঁচিশ বছর ছাত্রছাত্রীদের পড়িয়েছি। পরের দিন কী পড়াব আগের রাতে সেটা দেখে গিয়েছি, নিয়মিত সময়ে ক্লাসে হাজির হয়েছি। কঠিন বিষয় সহজ করে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, উদাহরণ দিয়েছি। তাদের প্রশ্ন করেছি, প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। তাদের মনোযোগ ছুটে গেলে পড়ানো থামিয়ে তাদের সাথে গল্প করে মনোযোগ ফিরিয়ে এনেছি। তাদের হোমওয়ার্ক দিয়েছি, পরীক্ষা নিয়েছি কিন্তু আমি একেবারে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি ‘আমি’ তাদের কিছু শেখাতে পারিনি। তার কারণ শেখার যে ব্যাপারটি আছে সেটি সবসময় তাদের নিজেদের করতে হয়েছে। হল, হোস্টেল, বাড়িতে, লাইব্রেরি কিংবা সেমিনার রুমে গিয়ে তাদের নিজেদের বই কিংবা ক্লাসনোট নিয়ে বসতে হয়েছে, নিজে নিজে চিন্তা করে নিজেকে শিখতে হয়েছে। ছাত্রজীবনে আমিও তাই করেছি, এখনও নূতন কিছু শিখতে হলে আমাকেও তাই করতে হয়।

শিক্ষা এবং শিক্ষক সম্পর্কে আমি যত ব্যাখ্যা পড়েছি তার মাঝে সবচেয়ে সুন্দর ব্যাখ্যাটি এ রকম: একজন শিক্ষক হচ্ছেন অন্ধকার ঘরে প্রদীপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মানুষ। সেই প্রদীপের আলোতে ঘরের সবকিছু শিক্ষার্থীরা দেখতে পায়- দেখার কাজটি শিক্ষক নিজে করে দিতে পারেন না সেটা ছাত্রছাত্রীদেরই করতে হয়।

যেহেতু শেখার পুরো ব্যাপারটা সবসময় ছাত্রছাত্রীদের নিজেদেরই করতে হয় তাই করোনাভাইরাসের এই গৃহবন্দি সময়ে ছাত্রছাত্রীরা ইচ্ছে করলে নিজেরাই তাদের পাঠ্যবই নিয়ে বসতে পারে। আমি দেখেছি আমাদের পাঠ্যপুস্তকগুলোও ধীরে ধীরে যথেষ্ট মানসম্মত হয়ে উঠছে, শুধু তাই নয় নেটে তাদের সব পিডিএফ বই পাওয়া যায়। কাজেই ঘরে বসে বসে নিজে নিজে পড়ার চেষ্টা করা নিশ্চয়ই এমন কিছু বাড়াবাড়ি ঘটনা নয়। আমার বাসায় স্কুল-কলেজে যাওয়া কোনো ছেলেমেয়ে নেই। যদি থাকত তাহলে আমি কী করতাম? আমি তাহলে তাদের বলতাম, ‘ঘরে বসে বসে পুরো গণিত বইটা শেষ করে ফেলো দেখি!’ তারা যদি চোখ কপালে তুলে বলত, ‘যদি করতে না পারি তাহলে কী করব?’ আমি তাহলে বলতাম, ‘সেগুলো নোট বইয়ে লিখে রাখো। যখন স্কুল খুলবে তখন স্যার-ম্যাডামকে জিজ্ঞেস করবে!’

আমি সংবাদমাধ্যমে দেখেছি টেলিভিশনে ছেলেমেয়েদের ক্লাস নেয়া শুরু হয়েছে। ছেলেমেয়েরা সেগুলো কতটুকু দেখার সুযোগ পাচ্ছে, তাদের কতটুকু লাভ হচ্ছে সেগুলো নিয়ে কোনো আলোচনা চোখে পড়েনি। কিন্তু চেষ্টা করা হচ্ছে তাতেই আমি খুশি। দুঃসময়ে যেটুকু বাড়তি পাওয়া যায় সেটাই লাভ।

আমি আমার সহকর্মী এবং পরিচিত শিক্ষকদের কাছ থেকে তাদের ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ার খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করেছি। সবাই নিজের মতো করে চেষ্টা করে যাচ্ছে। অনেকেই লেকচারগুলো নেটে তুলে দিচ্ছে। অনেকে আরও এক ধাপ এগিয়ে সত্যিকারের ক্লাস নেয়া শুরু করেছে। অনেকে একটা প্লাটফর্ম তৈরি করছে যেন লেকচার, ক্লাস, পরীক্ষা সবকিছু সমন্বিত করে ফেলা যায়।

করোনাভাইরাস আমাদের নানারকম সর্বনাশ করেছে এবং করে যাচ্ছে, কিন্তু এক ধাক্কায় লেখাপড়ার বড় একটা অংশ তথ্যপ্রযুক্তির আওতায় চলে আসছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে কেউ যেন মনে না করে সেটা সত্যিকারের স্কুল-কলেজ কিংবা ক্লাসরুমের জায়গা নিতে পারবে- সেটি কখনও হবে না, ধরে নিতে হবে এটা হচ্ছে একটা বিপর্যয়ের সময়ের জন্য ঠেকা দেয়া, সবাইকে একটুখানি ব্যস্ত রাখা।

আমি আশা করছি দেখতে দেখতে এই বিপদ কেটে যাবে এবং আবার স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছেলেমেয়েদের কলকাকলিতে মুখর হয়ে উঠবে। তাদের নাকের ওপর উটকো মুখোশ থাকবে না, পকেটে হ্যান্ড স্যানিটাইজার থাকবে না।

দেশবাংলাবিডি২৪/দে

Facebook Comments