বিপিএলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান কাঠগড়ায়

বাংলাদেশের প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগের নতুন এক আসরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কোনো ক্রিকেটারের উপস্থিতি ছিল না। এবারের আসরে নতুন আঙ্গিকে, নতুন নামে সাতটি দল খেলছে কিন্তু কোনো দলেরই পরিচিতি পর্ব বা কোনো ধরণের ক্রিকেটারের অংশগ্রহণ ছিল না বাংলাদেশ প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগের এই আসরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের যারা ভক্ত তাদেরও এই আসর থেকে চাওয়া-পাওয়া থাকে। যেহেতু টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট এবং এর প্রাথমিক যেসব চাহিদা ছিল তার মধ্যে একটি কম সময়ে দর্শকদের বেশি ক্রিকেটীয় বিনোদন দেয়া।
কিন্তু বলিউড তারকা এনে জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন হলেও বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের মানোন্নয়নে গত ছয়টি আসরে কতটা ভূমিকা রাখতে পেরেছে বিপিএল? বাংলাদেশের একটি ক্রিকেট সমর্থক গোষ্ঠী ‘দৌড়া বাঘ আইলো’র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবস্থাপক তানভীর আহমেদ প্রান্ত বিপিএল নিয়ে বেশ কড়া সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, “আমি যদি নিরপেক্ষ সমর্থক হতাম এবং আমার সামনে বিগ ব্যাশ, আইপিএল ও বিপিএল দেখার অপশন থাকতো একই সাথে। আমি অবশ্যই বিপিএলকে সবার শেষে রাখতাম।”
এর কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, “একই মাঠ, একই উইকেটে দিনের পর দিন খেলা হচ্ছে। যেখানে কখনো কখনো রান হচ্ছে আবার হচ্ছে না। যে ডেথ ওভার বোলিং ও স্লগ ওভার হিটিং আমরা দেখতে চাই সেটা আমরা পাইনা।”
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের অন্যতম বিনোদনের উৎস মারকাটারি ব্যাটিং ও সেটাকে রুখতে বোলারদের প্রচেষ্টা। অনেক সময়ই একটা ভালো বোলিং লাইন আপ টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ম্যাচের নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু তানভীর আহমেদ প্রান্ত’র মতে বোলিং বা ব্যাটিং কোনো দিক থেকেই বিপিএল উপভোগ্য কোনো আসর নয়।
বিপিএলে এবার মোট খেলা হবে ৪৬টি। তার মধ্যে একই ভেন্যুতে হবে ২৮টি ম্যাচ, সেটা ঢাকার মিরপুরে শের-ই-বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ক্রিকেট প্রাথমিকভাবে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ, বা আইপিএলের অনুকরণে বাণিজ্যিক একটা ভিত্তিতে শুরু করা হয়। কিন্তু ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের যে ক্রিকেট কাঠামো সেটার কোনো লক্ষন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে দেখা যায়নি।
ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে খেলে মোট আটটি দল, যারা হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ভিত্তিতে একে অপরের বিপক্ষে রাউন্ড রবিন লিগে প্রাথমিক পর্ব খেলে। যার ফলে প্রতিটি ভেন্যুতে উল্লেখযোগ্য দর্শক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ক্রিকেটের আরো একটি বড় লক্ষ্য ছিল লিগ পদ্ধতির এই খেলার বিকেন্দ্রীকরণ। অর্থাৎ ঢাকা কেন্দ্রিক যে ক্রিকেট কাঠামোতে। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ এবং সীমিত ওভারের টুর্নামেন্টগুলো যেভাবে ঢাকার মাঠেই সীমাবদ্ধ ছিল সেটায় পরিবর্তন আনা।
কিন্তু সাতটি মৌসুম শেষ হওয়ার পরেও বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গার আন্তর্জাতিক ভেন্যুগুলো এখনো অব্যবহৃত হয়ে আছে। যেমন খুলনার শেখ আবু নাসের ক্রিকেট স্টেডিয়াম ও বগুড়ার শহীদ চান্দু ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচ হয়না। যদিও সেখানে ঘরোয়া চারদিনের ম্যাচ আয়োজিত হয়, কিন্তু যথাযথ সংস্কার ও আন্তর্জাতিক সুযোগ সুবিধার যে প্রক্রিয়া তা চালু না করায় সেসব মাঠে বিপিএলের মতো আসর আয়োজন সম্ভব হয়নি। যদিও এসব মাঠে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আয়োজিত হয়েছে।
এই যেমন ২০১৫ সালেও খুলনার শেখ আবু নাসের ক্রিকেট স্টেডিয়ামে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ একটি টেস্ট ম্যাচ খেলে। ২০১৩ সালের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে খুলনার এই স্টেডিয়ামে তিনটি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
এরপরে চট্টগ্রামে নিয়মিত ম্যাচ আয়োজন করা হয় বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের, সম্প্রতি সিলেটও যোগ হয়েছে এই ভেন্যুর তালিকায়। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান আকরাম খান জানান, মাঠ বাংলাদেশে পর্যাপ্তই আছে, কিন্তু মূল সমস্যা টেলিভিশন সম্প্রচারের জন্য যেসব সুবিধা প্রয়োজন সেগুলো সব মাঠে নেই। দেখেন আমাদের কক্সবাজারে একটা দারুণ স্টেডিয়াম আছে, খুলনায় আছে। সেসব জায়গায় নিরাপত্তাও বেশ ভালোই। কিন্তু টেলিভিশন রাইটস নিয়ে সমস্যাটা হয়, এটাও ধীরে ধীরে আমরা কাটিয়ে উঠবো, এটায় একটা কমফোর্টেবল জায়গায় আসলে বাংলাদেশেও হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ভিত্তিতে খেলা সম্ভব।”
আকরাম খান আরো বলেন, “আগে এমন ছিল একটা জায়গায় খেলতাম এরপর একটা এসেছে, এরপর দুইটা এরপর তিনটা। ভারতের অবকাঠামো অনেক ভালো এবং পুরাতন, রাজ্যভিত্তিক আলাদা নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে।”
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ক্রিকেট যখন শুরু হয় ২০১২ সালে। সেবার বিপিএলের যে ছয়জন আইকন ক্রিকেটার ছিলেন তারা প্রত্যেকেই নিজেদের এলাকার প্রতিনিধিত্ব করতেন। যেমন ঢাকার মোহাম্মদ আশরাফুল খেলতেন ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরসে, বগুড়ার মুশফিকুর রহিম খেলেন একই বিভাগের দুরন্ত রাজশাহীতে, বরিশালের শাহরিয়ার নাফিস খেলেন বরিশাল বার্নার্সে, মাগুরার সাকিব আল হাসান খেলেন একই বিভাগের খুলনার খুলনা রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্সে এবং অলক কাপালি যিনি সিলেটের ক্রিকেটার তিনি খেলেছেন সিলেট রয়্যালসে।
কিন্তু বিপিএল যখন বিরতি দিয়ে ফের আসে তখন আর ক্রিকেটারদের আঞ্চলিক প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি আর দেখা যায়নি। ফলে বিপিএলের প্রাথমিক একটা লক্ষ্য ‘অঞ্চলভিত্তিক’ ফ্র্যাঞ্চাইজ এবং যেসব জেলা ও বিভাগের ভক্তরা নিজ নিজ বিভাগ বা জেলার দলকে সমর্থন দিবে সেটা আর হয়ে ওঠেনি।
মাঠে যেসব দর্শকরা এসেছেন তারা নির্দিষ্ট তারকা ক্রিকেটার বা তারকা খেলোয়াড়দের দেখতেই মাঠে আসেন, নির্দিষ্ট দলের সমর্থন আর ওভাবে দেয়া হয়নি। উমাইয়া জান্নাত বাংলাদেশের ক্রিকেটের একজন নিয়মিত দর্শক, তিনি জানান, “অনেক দেশের ক্রিকেটারদের সাথে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা খেলেন এটা দেখতে ভালো লাগে, তাই বিপিএল দেখতে আসি।”
কিন্তু তিনি বলেন মানের দিক থেকে বিপিএল তার প্রত্যাশিত জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের সপ্তম আসরে একটি দলের দায়িত্বে আছেন আকরাম খান। তিনি এবার রংপুর রাইডার্সের পরিচালক। দলে আঞ্চলিক খেলোয়াড়ের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে প্রশ্ন রাখা হলে তিনি বলেন, “এখন এটা ফ্রাঞ্চাইজিদের ওপর ছিল। এই যে ড্রাফট সিস্টেম সেখানে আসলে চাইলেই ইচ্ছামতো ক্রিকেটার পায় না। তাই ক্রিকেটারের এলাকার চেয়ে মানের দিকে লক্ষ্য রাখা হয় ও দলের প্রয়োজন কোনটা সেটা দেখা হয়।”
বাংলাদেশের ক্রিকেটে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের ইতিবাচক প্রভাব খুব একটা দেখা যায়নি। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের এই টুর্নামেন্ট মোট ছয়বার এর আগে আয়োজিত হয়েছে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশের অবস্থান এখন নয় নম্বরে, বাংলাদেশের ওপরে আছে আফগানিস্তানের মতো দল যারা ক্রিকেট খেলছে খুব বেশিদিন হয়নি। আফগানিস্তানেরও ঘরোয়া প্রিমিয়ার টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট হয় নিরপেক্ষ কোন ভেন্যুতে। সেখানেও বিদেশি ক্রিকেটাররা খেলে।
এই মুহূর্তে আফগানিস্তানের দুজন বোলার বিশ্ব টি-টোয়েন্টি র‍্যাঙ্কিংয়ের এক ও দুই নম্বরে আছেন- রশিদ খান ও মুজিব উর রহমান। আবার টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বর্তমান সেরা অলরাউন্ডারও মোহাম্মদ নবী আফগানিস্তানের ক্রিকেটার। ওদিকে পাকিস্তানের যে ফ্র্যাঞ্চাইজ টি-টোয়েন্টি লিগ পাকিস্তান সুপার লিগ, সেখান থেকেও ভালো ক্রিকেটার উঠে আসছে নিয়মিত।পাকিস্তানের ক্রিকেট বোর্ড যদিও নিরাপত্তা ইস্যুতে ঘরের মাটিতে খুব বেশি ম্যাচ খেলাতে পারেনি তবুও পাকিস্তান এই মুহূর্তে বিশ্বের এক নম্বর টি-টোয়েন্টি দল।
বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট লিগ বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে, বিদেশি ক্রিকেটারদের যে ভূমিকা সেটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ থাকে। কিন্তু ক্রিস গেইল, শহীদ আফ্রিদিরা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের যে ফ্রিল্যান্সার ঘরানা সেখানে আসলেও তারাও বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে তেমন অংশগ্রহণ দেখা যায়না।
এর আগেও ক্রিস গেইল, অল্প কিছু ম্যাচ প্রতি আসরে খেলেছেন। এছাড়া আরো যারা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটার আছেন অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের তারাও একই সময়ে নানা দেশে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ব্যস্ত থাকেন।
আরেকটা ব্যাপার হয় যে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের যে সময় সেই সময়টাতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটও চলে বিশ্বজুড়ে। যেমন এই সময় অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলঙ্কার খেলোয়াড়রা নিজ দেশের হয়ে খেলছেন।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের মিডিয়া বিভাগের প্রধান জালাল ইউনুস বলছেন আলাদা উইন্ডোর কথা। তিনি জানান, “আইপিএলের আলাদা উইন্ডো আছে শুধু, অন্য কোনো ঘরোয়া লিগের এমন উইন্ডো নেই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের সাথে এখন বোর্ডগুলো আলোচনা করছে, যে প্রাইম যেসব টি-টোয়েন্টি লিগ সেগুলোর জন্য নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিলে আরো বেশি খেলোয়াড় পাওয়া যেত এসব আসরে।”

Facebook Comments