স্মৃতি চুরি করবে হ্যাকাররা,ঠেকাবেন কীভাবে?

কল্পনা করুন, আপনি ইন্সটাগ্রামের ফিডের মতো আপনার স্মৃতিগুলো স্ক্রল করে দেখছেন। দেখছেন জীবনের পছন্দের মুহূর্তগুলো কিংবা ফিরিয়ে আনছেন প্রিয় মানুষদের স্মৃতি।এবার কল্পনা করুন এমন এক অরাজক ভবিষ্যতের যেখানে হ্যাকাররা আপনার সেইসব স্মৃতি হাইজ্যাক করে নিয়েছে এবং অর্থ না দিলে তা মুছে ফেলার হুমকি দিচ্ছে।মনে হতে পারে এটি কষ্টকল্পিত কাহিনি, কিন্তু এমন পরিস্থিতি আপনার কল্পনার চেয়েও দ্রুত ঘটে যেতে পারে।মস্তিষ্কটা যদি খুলে দেখা যায় নিউরো টেকনোলজির ক্ষেত্রে অগ্রগতি আমাদের সেই সুযোগের কাছাকাছি এরই মধ্যে নিয়ে গেছে, যার মাধ্যমে আমরা আমাদের স্মৃতিশক্তি বা মেমোরি বাড়াতে পারি। আর হয়তো কয়েক দশকের মধ্যেই আমরা স্মৃতিকে নিজের মতো করে সাজাতে বা ব্যাখ্যা করতে অথবা পুনরায় লেখার মতো অবস্থায় যেতে পারবো।মস্তিষ্ক পুনঃস্থাপনের জন্যে এই প্রযুক্তির জোরালো ব্যবহার মস্তিষ্কের শল্য চিকিৎসকদের জন্যে হয়তো সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।বিশ্বজুড়ে প্রায় দেড়লাখ মানুষের ক্ষেত্রে ডিপ ব্রেন স্টিমুলেশন (ডিবিএস) ব্যবহার করা হয়ে থাকে কিছু সমস্যার মোকাবিলার জন্যে। তার মধ্যে পারকিনসন্স থেকে শুরু করে অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসওর্ডার (ওসিডি) রয়েছে। নিরাময়ের এমন পদ্ধতি ডায়াবেটিস বা স্থুলতা নিয়ন্ত্রণেও ব্যবহার করা হতে পারে।বিষন্নতা, স্মৃতিভ্রংশ বা টুরেট সিনড্রোমের মতো বিভিন্ন মানসিক ব্যাধির নিরাময়ের জন্যে এমন নানা প্রযুক্তির পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।আর এসব পদ্ধতিগুলো রয়েছে এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে, গবেষকরা অনুসন্ধান করে বের করার চেষ্টা করছেন যে আঘাত বা পীড়নের ফলে যদি স্মৃতিলোপ পায় তবে তা কীভাবে পুনরুদ্ধার করা যায়।ইউএস ডিফেন্স অ্যাডভান্স রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সি-র (ডিএআরপিএ) একটি প্রোগ্রাম রয়েছে যেখানে সেনাদের আঘাতের ফলে ব্রেন ইনজুরি হলে স্মৃতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়।
মেন্টাল সুপারপাওয়ার
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জিক্যাল সায়েন্সের নাফিল্ড বিভাগের গবেষক লরি পাইক্রফট ভবিষ্যতের কিছু সময়সীমা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলছেন, আগামী দশ বছরের মধ্যে যদি বাণিজ্যিকভাবে স্মৃতি পুনঃস্থাপনের মতো বিষয় ঘটে তবে আমি মোটেও অবাক হব না।
তার হিসেবে, আগামী ২০ বছরের মধ্যে প্রযুক্তি হয়তো এমন সুবিধা এনে দেবে যাতে করে মস্তিষ্কের সেই সব সংকেত ধারন করা যাবে যা স্মৃতি বা মেমোরি তৈরি করে।আর এই শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এসে স্মৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাও চলে আসবে বলে মনে করেন পাইক্রফট।কিন্তু এই নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি যদি ভুল হাতে পড়ে তবে তার ফলাফল খুবই খারাপ হতে পারে বলে মনে করেন লরি পাইক্রফট।কল্পনা করুন যে, একজন হ্যাকার একজন পার্কিনসন্স রোগীর নিউরোস্টিমুলেটর-এর সূত্র জেনে ফেলেছেন এবং সেটি নিজের মতো করে সাজিয়ে ফেলেছেন। তখন সেই রোগীর চিন্তাশক্তিকে এবং আচরণকে সে প্রভাবিত করতে পারবে কিংবা তাকে পঙ্গুও করে ফেলতে পারবে।একজন হ্যাকার চাইলে ডার্ক ওয়েব-এর মাধ্যমে অর্থ দাবি করে বসতে পারে, আর যদি তা না পায় তবে সব স্মৃতি মুছে ফেলা বা নতুন করে স্মৃতি তৈরির হুমকিও দিতে পারে।২০১২ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক হেডসেট ব্যবহার করা হয় এমন একটি জনপ্রিয় গেমিং থেকে মানুষের ব্রেনওয়েভ পর্যবেক্ষণ করে ব্যাংক কার্ডের পিন নম্বরের মতো তথ্য বের করে ফেলেছিলেন।
আপনার অতীতকে নিয়ন্ত্রণ সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা কোম্পানি ক্যাস্পারস্কির একজন গবেষক দিমিত্রি গ্যালভ বলেন, ব্রেনজ্যাকিং এবং স্মৃতি পরিবর্তন নিরাপত্তার জন্যে বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে বলছিলেন ।ভবিষ্যতের প্রযুক্তিগত ঝুঁকি কী কী হতে পারে তা নিয়ে ক্যাসপারস্কি এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় যৌথ ভাবে কাজ করেছিল। ‘স্মৃতি বাজার: ভবিষ্যতে যেখানে সাইবার নিরাপত্তার ঝুঁকি আপনার অতীতকে নিয়ন্ত্রণ করবে’ এটি ছিল সেই যৌথ কাজের রিপোর্টের শিরোনাম।যেখানে বলা হয়েছে যে, এটি মোটেও অবাক হবার মতো বিষয় হবে না যে- ভবিষ্যতের কোনো একনায়ক তার ইতিহাস আবার লেখার চেষ্টা করতে পারে দেশটির জনগণের স্মৃতিতে হস্তক্ষেপ করে।
অননুমোদিত​ প্রবেশাধিকার
ইন্টারনেটে সংযুক্ত এমন মেডিকেল ডিভাইসকে হ্যাক করা মোটেও গল্পে উল্লেখিত বিষয় নয়।২০১৭ সালের ঘটনা, যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ সাইবার নিরাপত্তার গোপনীয়তা জনিত ঝুঁকি বিবেচনা করে ৪ লাখ ৬৫ হাজার পেসমেকার পুনরায় ফিরিয়ে আনে।দেশটির ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) জানায়, অসাধু ব্যক্তিরা চাইলে ডিভাইস নিয়ন্ত্রণ করে হৃদযন্ত্রের গতি পরিবর্তন বা পেসমেকারের ব্যাটারি নিয়ন্ত্রণ করে মৃত্যু ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারতো।
যদিও কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি সেবার, তবু এফডিএ বলছে যে, মেডিকেল ডিভাইসগুলো ক্রমাগত ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংযুক্ত হয়ে পড়ছে হাসপাতালের তথ্যভান্ডার বা অন্য মেডিকেল ডিভাইস বা স্মার্টফোনের সাথে। আর এরইসাথে বাড়ছে সাইবার অপরাধ জনিত ঝুঁকি।অনেক চিকিৎসাক্ষেত্রের জন্যেই এই সমস্যা রয়েছে এবং ক্যাস্পারস্কি মনে করেন যে, ভবিষ্যতে আরো অনেক ডিভাইসই এমনভাবে সংযুক্ত হবে এবং দূরবর্তী যন্ত্রের সাথে সেগুলো নিয়ন্ত্রণও করা যাবে। খুব জরুরি অবস্থাতেই কেবল ডাক্তারকে ডাকা হবে।
সাইবার প্রতিরক্ষা সৌভাগ্যক্রমে সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে সচেতনতা তৈরি হওয়ায় মেডিকেল ডিভাইসগুলির নকশা এবং পরিকল্পনা এমনভাবে করা হচ্ছে যাতে করে তা ঝুঁকির পরিমাণ কমাতে পারে।তবে গ্যালভের মতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো রোগী এবং চিকিৎসা সংশ্লিষ্টদের এমনভাবে প্রশিক্ষিত করে তোলা উচিৎ যাতে করে তারা সতর্কতা অবলম্বন করতে পারে। যেমন হতে পারে শক্তিশালী পাসওয়ার্ড নির্ধারন।তবে বাস্তব সমস্যা হলো একজন চিকিৎসককে সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ হতে বলাও সম্ভব নয়।পাইক্রফটের মতে ভবিষ্যতে মস্তিষ্ক পুনঃস্থাপনের ক্ষেত্র আরো জটিল এবং ঝুঁকির পরিধি আরো বিস্তৃত হতে পারে। যদি না এখন থেকেই সতর্কতা অবলম্বন করা হয়।

Facebook Comments