কালিয়াকৈরে বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটি বিনিয়োগে নতুন মাত্রা আনবে

গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈরে ‘বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটি’র সামগ্রিক কার্যক্রম বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে নিয়ে পরিদর্শন করলেন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। আজ বুধবার দুপুরে বিনিয়োগকারীদের জন্য সদ্য চালুকৃত কমিউটার ট্রেনে চড়ে তিনি এই হাই-টেক পার্কে আসেন। পরিদর্শন শেষে প্রতিমন্ত্রী কালিয়াকৈরে ডেভেলপার ও বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হোন।
কালিয়াকৈরে নির্মিত বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটি রেল স্টেশনটি গত বছরের ১ নভেম্বর তারিখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উদ্বোধন করেন। এটা ছিল বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটিতে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের দীর্ঘদিনের দাবি। এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটিতে বিনিয়োগকারী এবং সেখানে কর্মরত লোকজন খুব সহজে এবং অল্প সময়ে ঢাকা থেকে বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটিতে যাতায়াত করতে পারবেন। এর ফলে হাইটেক পার্কটি খুব দ্রুত কর্মচঞ্চল হয়ে উঠবে বলে আশা করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ‘বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটি কমিউউটার ট্রেন-১’ এবং বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটি কমিউউটার ট্রেন-২’ নামে দুটি ট্রেন প্রতিদিন চারবার ঢাকা থেকে কালিয়াকৈর যাতায়াত করছে। আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, ১৯৯৯ সালে বিনিয়োগ বোর্ডের ১২তম সভায় প্রধানমন্ত্রী গাজীপুরের কালিয়াকৈরে হাই-টেক পার্ক নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু পরবর্তী সরকার এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেনি। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবারো এই হাই-টেক পার্ক আলোর মুখ দেখে। আমরা ক্ষমতায় এসে ২০১৪ সালে এই এলাকার উপর থাকা বিভিন্ন ধরনের মামলা নিষ্পত্তি করি এবং সে বছরের ১২ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় জায়গাটি পরিদর্শন করেন। হাই-টেক পার্কের বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও ট্রেন কানেক্টিভিটি খুব দরকার ছিল। আমরা উপলব্ধি করেছিলাম যে, ট্রেন যোগাযোগ ছাড়া এই হাই-টেক পার্ক সফলতা পাবে না। সে সময় সজীব ওয়াজেদ জয় নির্দেশনা দিয়েছিলেন এখানে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য। আমরা সেসময় রেলমন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। তখন আমরা গাজীপুরের কালিয়াকৈরে আধুনিক রেলস্টেশন স্থাপন করার পরিকল্পনা করেছিলাম, যা অতি সম্প্রতি বাস্তবায়িত হয়েছে। কালিয়াকৈরে ৩৫৫ একর জমির উপর স্থাপিত ‘বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটি’ বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের প্রথম প্রকল্প। বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ এ পার্কের প্রয়োজনীয় সকল অফসাইট ইনফ্রাস্ট্রাকচার নির্মাণের কাজ শেষ করেছে। ইতিমধ্যে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব মডেলে (পিপিপি) ২টি ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের কাছে ১৪০ একর জমি প্রদান করা হয়েছে। ডেভেলপার কোম্পানি সামিট টেকনোলজিস বিডি লি. কর্তৃক ৬০ হাজার বর্গফুট বিশিষ্ট ফ্যাক্টরি ভবন এবং ১ লাখ ৬৫ হাজার বর্গফুট বিশিষ্ট সিগনেচার বিল্ডিং নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। অন্য ডেভেলপার কোম্পানি টেকনোসিটি বিডি লি. এর ২ লাখ বর্গফুট বিশিষ্ট মাল্টি-টেন্যান্ট বিল্ডিং নির্মাণ কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। পার্কটিতে একটি সার্ভিস বিল্ডিং (২৭,২৬০ বর্গফুট) নির্মাণ করা হয়েছে, যেখানে দুইটি আইটি প্রতিষ্ঠান ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) প্রোডাক্ট তৈরির কাজ শুরু করেছে এবং একটি প্রতিষ্ঠান প্রোডাক্ট বাজারজাত করছে। চীনের সহযোগিতায় প্রায় ১৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই হাই-টেক পার্কেই গড়ে উঠছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ টায়ার ফোর ডাটা সেন্টার। ইতিমধ্যে এই জাতীয় ডাটা সেন্টারের ৯৯ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে, শিগগির এখানে কাজ শুরু হবে। বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ সরাসরি বিনিয়োগকারীদের অনুকূলে প্রথম পর্যায়ে গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর তারিখে ৯টি কোম্পানিকে ২০.০৫ একর ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ১০ ডিসেম্বর তারিখে আরো ৯টি কোম্পানিকে ২৮ একর প্লট বরাদ্দ প্রদান করেছে। এর মাধ্যমে আগামী ৪০ বছরের জন্য বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটিতে রবি আজিয়াটা, জেনেক্স, বিজেআইটি সফটওয়্যার, ফেয়ার ইলেকট্রনিক্স, কেডিএস গ্রুপ, ইন্টারক্লাউড, বিজনেস অটোমেশন, নাজডাক টেকনোলজিস এবং জেআর এন্টারপ্রাইজ নামীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ বিনিয়োগের সুযোগ পায়। ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলো সেখানে কাজ শুরু করেছে। কোম্পানিগুলো সেখানে প্রায় ১৪০.৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ ও ২৫,০০০ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
দ্বিতীয় ধাপে ডাটা সফট, আমরা হোল্ডিংস, ভেড নেট লিমিটেড, স্পেকট্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কনসোর্টিয়াম লিমিটেড, মিডিয়া সফট ডাটা সিস্টেম লিমিটেড, ইউ ওয়াই সিস্টেম লিমিটেড, এসবি টেল এন্টারপ্রাইজ এবং ইউনিকম বাংলাদেশ অ্যান্ড সিস্টেক ডিজিটাল লিমিটেড নামীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ বিনিয়োগের সুযোগ পেয়েছে। এছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘এক্সপোর্ট কম্পিটিটিভ ফর জবস’ শীর্ষক প্রকল্প এখানে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে কাজ করবে। এই কোম্পানিগুলো ও প্রকল্পটি এখানে ১৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ ও প্রায় ২০,০০০ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। উল্লেখিত ১৮টি কোম্পানি হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার, আইওটি, বিপিও, ট্রেনিং সেন্টার, ডাটা সেন্টার, ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন সংযোজন/উৎপাদন, আরঅ্যান্ডডি প্রভৃতি উচ্চ প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করবে, যা এই হাই-টেক পার্কে কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি করবে। মতবিনিময় সভায় আইসিটি প্রতিমন্ত্রী পলক বলেন, হাই-টেক পার্ক/সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কগুলো সফটওয়্যার, ইলেকট্রনিক্স ইত্যাদি পণ্য রপ্তানীর মূল কেন্দ্র হয়ে গড়ে উঠবে। প্রথম পর্যায়ে দেশে এ পর্যন্ত ২৮টি আইটি/হাই-টেক পার্ক স্থাপনের কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। সরকার পর্যায়ক্রমে দেশের সকল বিভাগ/জেলায় আইটি/হাই-টেক পার্ক স্থাপন করবে। আইটি শিল্পকে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসতে এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সম্পৃক্ত করতে সুলভ মূল্যে প্রতিটি হাই-টেক/আইটি পার্কে স্পেস দেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও স্টার্ট-আপদের বিনামূল্যে স্পেস দেওয়ার মাধ্যমে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। বর্তমান সরকার যে জ্ঞানভিত্তিক ও মেধানির্ভর অর্থনীতির উপর জোর দিচ্ছে, তরুণরাই হবে তার মূল চালিকাশক্তি। আমরা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এবং প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টার সু-পরামর্শে তরুণদের কাজ করার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়েছি, চমৎকার পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (সচিব) হোসনে আরা বেগম বলেন, বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটিতে প্লট বরাদ্দ নেওয়ার জন্য বিনিয়োগকারীদের মধ্যে প্রবল আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। আমরা বিনিয়োগকারীদের সব রকম সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করছি। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ১৪টি প্রনোদনা সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে। এসব কার্যক্রম আরো সহজীকরণের জন্য বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ কাজ করছে। সম্প্রতি আমরা অনলাইনভিত্তিক ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করেছি, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য খুবই কার্যকর হবে। সম্প্রতি চালুকৃত ট্রেন সার্ভিস বিনিয়োগকারীদের যাতায়াতের সময় ও খরচ কমিয়ে আনবে, ফলে তারা এখন নিশ্চিতে বিনিয়োগ করতে পারবেন। আমরা বিনিয়োগকারীদের জন্য ‍উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে যা যা করার প্রয়োজন তাই করবো। ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু হাই-টেক পার্ক থেকে আইটি পণ্য রপ্তানি শুরু হয়েছে। শিগগির এখানে মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপসহ বিভিন্ন হার্ডওয়্যার পণ্য উৎপাদিত হবে।
প্রতিমন্ত্রীর হাইটেক পার্কে পরিদর্শনকালে বিনিয়োগকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, আইসিটি খাতের বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এবং গণমাধ্যমকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

Facebook Comments